সম্পাদকীয় সর্বশেষ সাহিত্য

পুরুষ : মাতৃসত্ত্বা ও স্ত্রী সত্ত্বার এক অনন্য পরিবাহক

ভোরের আলোর উষ্ণতা আলিঙ্গন করেছে শহরের বুকে, বেজে গিয়েছে শহরের কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটে চলার সাইরেন। জানালার পর্দা ভেদ করে সূর্যের রশ্মি চোখে পড়তেই বিছানা থেকে উঠে সোজা রান্না ঘরে চলে আসলো সুভাষ। নিত্যদিনের রুটিনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আজ তার এখানে আসার কারণ তার স্ত্রীর পছন্দের নাশতা তৈরী করা। পছন্দের খাবার অনেক থাকলেও একমাত্র ফ্রেঞ্চ টোস্ট টাই সে বানাতে পারে, কারণ ডিমের মিশ্রনে পাউরুটি মাখিয়ে তেলের মধ্যে এপিঠ-ওপিঠ কয়েকবার ভেজে নিলেই হয়ে যায় ফ্রেঞ্চ টোস্ট। গেল মহামারীতে চাকরী হারিয়েছে সে, নতুন চাকরীর বেতনে খরচ উঠে না , তাইতো সংসারের ব্যয়ভার মেটাতে তার স্ত্রীকে করতে হচ্ছে অতিরিক্ত কাজ, ভোরে উঠা আর বাড়তি কাজ শেষে রাত দেরী করে ঘুমাতে যাওয়া, প্রতিদিনকার এই ধকলে রোগাশ্রয়ী হয়ে পড়েছে তার প্রিয়তমা, তার অর্ধাঙ্গিনী, তার সন্তানের মা। সেজন্যই নিত্যদিনের এই রুটিনের ফাকে একটি স্নিগ্ধ, চাপমুক্ত ও হা দেওয়ার জন্য তার এই ব্যস্ততা। লোকে বলে অভাব আসলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়, কিন্তুু তারা জানেনা অভাব সত্যিকারের ভালোবাসার রংকে আরো গাঢ় করে। এই ছোট্ট নীড়ে তারই চিত্রায়ন ঘটেছে।

সুভাষকে রান্নাঘরে দেখতে পেয়ে কিছুটা জোরে সোরেই রান্নাঘরে আসলো তার মা। গত ৩০ টি বছরে কখনো এমনটি হয় নি সুভাষ তার মায়ের আগে ঘুম থেকে উঠতে পেরেছে সে দিন যাই হোক না কেন, অবস্থা যেরকমই হোক না কেন।  আর বুড়ো বয়সে তো যেন চোখের ঘুমই কেড়ে নেন স্রষ্টা যার মাধ্যমে হয়তো বোঝাতে চান ঘুমিয়ে কী করবে? আর তো আছোই কয়দিন, দেখে নাও আমার সৃস্টি, তার পর তো ঘুৃমিয়ে রবে চিরকাল। সুভাষকে রান্নাঘরে নিজের স্ত্রীর জন্য নাশতা বানাতে দেখে তার মা বলেই ফেলল, “বউয়ের জন্য তো দেখি অনেক দরদ, সকালে উঠে নাশতা বানাচ্ছিস, কই কোনদিন তো আমার জন্য এক কাপ চা-ও বানালিনা”

কথাটি সুভাষের কর্ণভেদ করে ঢুকলো ঠিকই কিন্তু বের হয়ে আর আসলো না বরং কথাটি তার মস্তিস্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। সে তার স্মৃতিতে জোর দিয়ে মনে করতে লাগলো কবে সে তার মায়রে জন্য কোনো খাবার বানিয়েছে। সে অবাক হয়ে গেলো, কারণ তার মায়ের সাথে এরকম কোন স্মৃতিই নেই! কিন্তুু তার স্ত্রীর জন্যও সে দু সপ্তাহ আগে নাশতা তৈরী করেছিল। সে এই ভাবনায় মগ্ন, অমনি সময় চুলায় গরম তেল ফুটতে শুরু করল সে ডিমের মিশ্রণে ডুবানো রুটিটি আস্তে করে তেলের মধ্যে ছেড়ে দিল।

তার হঠ্যাৎই মনে পড়ল তার মা কখনোই তাকে চুলার কাছে ঘেষতে দিত না, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে এই ভয়ে। ছুড়ি ধরতে দিত না কেটে যাবার ভয়ে, গরম তেলের কাছে যেত দিত না গায়ে ছিটে আসার ভয়ে, তার মা তো তাকে সুযোগই দিত না তাহলে সে কিভাবে কিছু বানিয়ে মাকে আপ্যায়ন করবে? এখানে তো মায়েরই দোষ, সে আমাকে সুযোগই দেই নি। কিন্তুু এটি কি আদোও দোষ নাকি সন্তানকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস মাত্র। কিছু খেতে চাইলে চটজলদি তা বানিয়ে খাওয়াত, যখনই খেতে বসতাম খাবার বেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করত, রাত-বিরাতের বালাই নেই। থাকতনা কোন উপেক্ষার সুর।

কিন্তুু সেই মায়ের সাথে এখন আর একসাথে বসে খাওয়া হয় না, বলা হয় না আগের মতো গল্প, টেবিলে অপেক্ষার দ্বায়িত্বে এখন অন্য একজন – আমার স্ত্রী। তাহলে কী মাতৃসত্ত্বা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি! কিন্তু সেটি তো হবার নয়, কারনে তার গর্ভেই তো আমার জন্ম, আমাদের নাড়ী এক, তার দেহের পুষ্টি শোষন করে আমার বৃদ্ধি। তাহলে আলাদা হব কিভাবে?

তাহলে কী আমার ভালোবাসায় রয়েছে কোন অসমতা। কিন্তুু আমি তো দুজনকেই ভালোবাসতে চাই, বেশি কম বুঝি না যতটুটু ভালবাসা যায় ততটুটকুই ভালোবাসতে চাই। নাকি রসায়নের অনিশ্চয়তার নীতির মতো দুজন মানুষকে সমান ভালোবাসা যায় না? কিন্তুু জীবন তো আর বিজ্ঞান নয়। তাই এখানে প্রমানের উর্ধ্বে গিয়ে বিশ্বাসের জয় হয়।

উদ্ভট সংকটে পতিত সুভাষ হয়তো জানেনা পর্বতসম ভালোবাসাও তুচ্ছ মনে হবে যদি না ভালেবাসার মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারেন আপনি তাকে ভালোবাসেন।

বলা হয় মানুষ বয়স হলে শিশুর মতো হয়ে যায়। শিশুরা যেমন নিশ্চুপ ভাবে এক মুহূর্ত পার করতে পারে না বয়স্ক মানুষও তাই, তারা চায় সঙ্গ, আরো চায় গ্রহনযোগ্যতা। একে তো বার্ধ্যকের জন্য মানুষের কাছে তাদের গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে কিন্তুু এই গ্রহনযোগ্যতা যখন কাছের মানুষের কাছেও কমতে শুরু করে তখন তাদের মনে শংকার দানা প্রকট হতে থাকে।কেননা বিদায় বেলায় সকলেই সুখস্মৃতি নিয়ে যেতে চাই, নাকি কষ্ট-অবহেলার স্মৃতি।

একজন নারীর নিকট সবচেয়ে দামী তার সন্তান। সন্তানের জন্য সর্বদা ত্যাগ কষ্ট শিকার করে আসা মাতৃসত্ত্বা যখন সেই সন্তানের কাছে গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তখন দুনিয়াতে তার অস্তিত্ব নিয়েই সে সন্দিহান হয়ে পড়ে। ফলে মাতৃসত্ত্বা শুরু করে নিজের অস্তিত্বের টিকিয়ে রাখার লড়াই। প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় সন্তানের অর্ধাঙ্গীনী। কেননা স্ত্রীর কাছেও স্বামীও যে মহামূল্যবান উপহার। কেউই কারো দামী, মূল্যবান সম্পদ কিংবা উপহার হারাতে চায় না। এই লড়াইয়ে জিত তো হাসিল হয়ই না, উল্টো ছারখার হয়ে ঘর,পরিবার, একটি সুন্দর সংসারের।

সন্তানের কি দোষ ছিলো এতে, শুধুমাত্র ভালেবাসা জাহিরের ব্যর্থতায় তাকে এতো চড়া মূল্য দিতে হলো! সে তো চেয়েছিল মাতৃসত্তা, স্ত্রী সত্তা উভয়কেই লালন করতে। কেননা তার বিশ্বাস মা হচ্ছে আমার দুর্গম পথে ছুটে চলার সাহস আর স্ত্রী সে দুর্গম পথের সহচর। দুটি সত্তাই তার পরিপূরক। সন্তানের মনে পড়ে যখন তার মা বলেছিল, আমার রাজপুত্রের খেলার সাথী হিসেবে একটি রাঙা পরী নিয়ে আসব। আর তার স্ত্রী বলেছিল, ” মা তো মা-ই হয়, তোমার মা – আমার মা এটা আবার কেমন কথা!  “। কিন্তুু আজ কোথায় দুজনের অনুভূতি?

এত কিছু ভাবতে ভাবতে স্ত্রীর প্রিয় ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানানো শেষ। এর মধ্যে মা কয়েকবার রান্নাঘরে এসেছে বিভিন্ন বাহানায়। হয়তো সুভাষকে পাহারা দিচ্ছে। নাশতা নিয়ে স্ত্রী কাছে যাওয়ার পর বলল, “এতগুলো আমি খাব না, কিছু মাকে দিয়ে আস।” সুভাষ মায়ের রুমে নাশতা নিয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে এরপর আর মা বলতে পারবে না তাকে আমি কিছু বানিয়ে খাওয়াইনি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *