বিদেশ শিক্ষা সর্বশেষ

কানাডায় পড়তে আসার আগে যেসব বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে

কানাডার শীর্ষ তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু কানাডা বলে কথা নয়, সারাবিশ্বের প্রথম বিশ বা পঁচিশটি বিশ্ববিদ্যালয় গণনা করলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাদ পড়ে না। স্বভাবতই, বিশ্বের নামিদামি অনেক অধ্যাপক এবং গবেষককে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে দেখা যায়।

এ ধরনের উঁচুমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি করার সময়ও বেশ যাচাইবাছাই করে দেখা হয়। আমার সুবিধা ছিল, আমার বুয়েটের ভালো ফলাফলের পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস এর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর আগে আমার আরেকটা মাস্টার্স ডিগ্রিও করা ছিল। সম্ভবত এ অর্জনগুলো আমার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সহায়ক হয়েছিল।

আমি যে প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলাম সেই একই প্রোগ্রামে বাংলাদেশের এক প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (নামটা না বলি) এক তরুণ শিক্ষকও এসেছিলেন পড়াশোনা করতে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বাঙালি, ভারতীয় না পাকিস্তানি স্থির করতে না পেরেই- হয়তোবা দুজনের মাঝে কথা হয়নি। পরে একসময় যখন জানতে পারলাম তিনি বাংলাদেশি।

তারপর বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই গড়ে উঠলো বলা চলে। তিনি বয়সে আমার বছর পাঁচেকের ছোট। আমরা দুজন একই প্রোগ্রামে পড়লেও আমি পড়ছি কানাডার পিআর বা, পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস নিয়ে। আর, তিনি হলেন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট, মানে বিদেশি ছাত্র। ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস ভিন্ন হবার কারণে তার টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচ আমার খরচের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি।

তাছাড়া, পড়াশোনায় একটা কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে না পারলে তার ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট স্ট্যাটাসেরও ক্ষতি হতে পারে। কানাডার পিআর হওয়ায় আমাকে আর যাই হোক, পড়াশোনায় সফল না হলেও অন্তত আমার অভিবাসন নিয়ে ভাবতে হচ্ছিলো না। সঙ্গত কারণেই, আমার এ ছোট ভাইটির মতো ততবেশি টেনশনের মধ্যে দিয়েও আমাকে যেতে হয়নি।

ছোটোভাইটি একদিন ক্লাস শেষে আমার সাথে বসলেন ক্যাম্পাসের একটা কফি শপে। এ কথা সে কথার ফাঁকে একটা সিরিয়াস বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইলেন আমার।

সমস্যা হলো, তিনি নাকি আমাদের চলমান মাস্টার্স প্রোগ্রামের একটা কোর্সে ইতোমধ্যে ‘সি’ গ্রেড পেয়ে গেছেন। তাই, ভয় হচ্ছে দ্বিতীয় কোন কোর্সেও আবার ‘সি’ পেয়ে যান কিনা। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, কানাডার উঁচুমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স পর্যায়ে একটার বেশি কোর্সে ‘সি’ পেয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় ওই ছাত্রকে স্টাডি প্রোগ্রাম থেকে বহিষ্কার করে।

তিনি ভাবছেন, তার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটলে তো তাকে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হবে। একইসাথে, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট স্ট্যাটাসও হুমকির মধ্যে পড়বে। ওদিকে দেশে নাকি বিয়ের জন্যও তার এক ছাত্রীকে ঠিক করে রেখেছেন বাবা-মা। প্রোগ্রাম থেকে বহিষ্কার হয়ে দেশে ফিরে গেলে চাকরি হয়তো যাবে না, কিন্তু বাগদত্তার কাছে মুখ দেখাবেন কী করে?

কথাগুলো বলতে বলতে এ ছোটভাইয়ের ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাওয়ার অবস্থা। তাই, তাকে শান্ত করতে খানিক রসিকতা করে বললাম, ‘আরে মিয়া এতো টেনশন করছো কেন, দেশে যদি ফিরে যেতেই হয় তবে দেশে ফিরে সবাইকে বলবে, দেশমাতৃকার টানে কানাডার স্বপ্নিল জীবন ছেড়ে দেশের ছেলে দেশেই ফিরে গেছো। প্রয়োজনে আমাকে সাক্ষী করো। বিষয়টা জানাজানি হলে পত্রপত্রিকায়ও হয়তো তোমাকে নিয়ে দেশপ্রেমের কাহিনী ছাপবে।’

আমার রসিকতা ধরতে পেরে ছোটোভাইটি কথাগুলো সহজভাবেই নিয়েছে। যাই হোক, অনেক ভেবেচিন্তে তাকে পরামর্শ দিলাম কানাডায় র‌্যাংকিং-এ পেছনের দিকে আছে এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিশ্ববিদ্যালয়ের নামোল্লেখ করে কাউকে বিব্রত করতে চাই না) ক্রেডিট ট্রান্সফার করে দ্রুত চলে যেতে। কারণ, ওখানে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এতটা তীব্র প্রতিযোগিতা হবে না; ফলে, ভালো গ্রেড পাওয়াও অসম্ভব হবে না। প্রস্তাবটা তার মনে ধরলো।

যেই কথা সেই কাজ; ঠিকঠিক চলে গেল সে। এ ঘটনার পর আমার সাথে বছর তিনেক যোগাযোগ ছিল না। একসময় জানলাম তিনি ওখানে এতবেশি ভাল রেজাল্ট করেছেন যে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলভাবে মাস্টার্স ও পিএইচডি শেষ করে কানাডার অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন কয়েকবছর। ইতিমধ্যে কানাডার ইমিগ্রেশনও হয়ে গেছে তার। তার মানে, এ দেশপ্রেমিকের আর খালি হাতে দেশে ফিরে যেতে হয়নি।

আমার এ ছোটোভাইটির কাহিনী এতটা বিস্তারিত বর্ণনা করেছি এ লেখার প্রয়োজনে। এ ঘটনা থেকে যা শিক্ষণীয় তা হলো, বাংলাদেশ বা অন্য কোথাও হতে যারা ইমিগ্রেশনের চিন্তা মাথায় রেখে কানাডায় পড়াশোনা করতে আসছেন তারা স্টাডি প্রোগ্রাম নির্বাচনের সময় সার্বিক বিষয়াদি সূক্ষ্ণভাবে বিচার বিবেচনা করবেন।

বেশি চিন্তা না করে টপ র‌্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে আসলে পরবর্তীতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কানাডার একজন রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা, আরসিআইসি হিসেবে আমি আমার ক্লাইয়েন্টদের মধ্যে যারা কানাডা ইমিগ্রেশন-ভাবনা মাথায় রেখে কানাডায় পড়তে আসেন তাদের সবসময় বলি একটি অপেক্ষাকৃত সহজ ও চাকরি পেতে সুবিধা হয় তেমন প্রোগ্রামে ভর্তি হতে।

এতে সুবিধা হলো এই, কানাডার পড়াশোনা শেষ করে সনদ হাতে পেলে এই শিক্ষার জন্য বেশ ভালো পয়েন্ট পাওয়া যায়। সেই সাথে, কানাডায় অন্তত এক বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে আরো অতিরিক্ত পয়েন্ট পাওয়া যায়। এ দুই খাত থেকে পয়েন্ট এসে যোগ হলে কানাডা ইমিগ্রেশন অনেক সহজ হয়ে উঠে। তারপর একসময় কানাডা পিআর হয়ে গেলে যতখুশি ডিগ্রি নিন, আপনাকে কেউ বাধা দেবে না। পিআর হবার পর কানাডা সরকার হতে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে পড়াশোনা করা যায়। পড়ালেখা শেষ হবার পরপর চাকরি পাওয়া না গেলে কানাডা সরকার সে ঋণের সিংহভাগ আবার মাফও করে দেয়। দেখুন, পিআর বা সিটিজেনদের জন্য কানাডায় পড়াশোনা কতটা সহজসাধ্য!

কানাডায় স্টাডি বা পড়াশোনা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আজকের লেখা শেষ করবো। যাদের কানাডা অভিবাসনের চিন্তাভাবনা আছে তারা বিশেষ মনোযোগ দিয়ে নিচের পয়েন্টগুলো পড়তে পারেন।

এক.  কানাডায় যে স্টাডি প্রোগ্রামে পড়তে যাচ্ছেন তা শেষ করে সেখানে চাকরি পাবার সম্ভাবনা কেমন তা শুরুতেই বিবেচনায় রাখবেন। কেননা, কানাডা ইমিগ্রেশনের সম্ভাবনা বাড়াতে আপনার কানাডার শিক্ষা এবং কাজের অভিজ্ঞতা দুটোই দরকার। এ দুটো থাকলে আপনার সিআরএস স্কোর অনেক বেড়ে যাবে। ফলে, আপনার কানাডা ইমিগ্রেশনপ্রাপ্তি একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যায়।

দুই.  আলঙ্কারিক পড়াশোনা, যেমন, মাস্টার্স, পিএইচডি, ইত্যাদিতে প্রয়োগিক (প্রেক্টিকেল) দিকের চেয়েও থিওরি বেশি। ফলে, ডিগ্রিগুলো নামে গালভরা হলেও এসব করে চাকরি পেতে সময় লেগে যায়।

ওদিকে, কানাডায় পড়াশোনা শেষের একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরি না পেলে আপনার ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট স্ট্যাটাসও চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুত কানাডা ত্যাগের বিশেষ বিকল্প থাকে না।

তিন.  কানাডায় বিদেশি নাগরিকদের (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট) পড়াশোনা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ; তাই, বিদেশি নাগরিক স্ট্যাটাসে যত লম্বা পড়ালেখা করবেন খরচও ততো বেশি হবে। নিজ খরচে এ ধরনের দীর্ঘ স্টাডি প্রোগ্রামে যাওয়া উচিত কেবল আপনার হাতে অঢেল অর্থ সঞ্চিত থাকলে, বা সরকারি বৃত্তি পেলে। নিজ খরচে পড়তে হলে এমন কোনও প্রোগ্রামে ভর্তি হবেন যা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং যা শেষ করে

কানাডায় পড়াশোনা করে যাদের সেখানে অভিবাসন নেওয়ার চিন্তা নেই তারা যা মন চায় পড়তে পারেন। তাদের ক্ষেত্রে আমার উপরের পরামর্শগুলো প্রযোজ্য মনে হয় না।

মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতির দিক থেকে কানাডার সাথে বাংলাদেশের আকাশ-পাতাল তফাৎ। কানাডায় পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য তা বাস্তব কাজে লাগানো; অথচ, বাংলাদেশের সমাজে আলঙ্কারিক ডিগ্রির চাহিদাই বেশি। কানাডায় পড়ালেখার সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে দরকার একটা সুচিন্তিত স্টাডি প্ল্যান। একজনের জন্য যা ভালো তা অন্যের জন্য ভালো নাও হতে পারে। কারণ, সবার চাহিদা, পরিস্থিতি বা উদ্দেশ্য অভিন্ন নয়।

যাক, এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। কানাডায় পড়াশোনা, বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে। এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার লেখা পড়তে। আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের আগ্রহ নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।

মূল লেখা : বিডিনিউজ২৪.কম

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে লিডবার্গ এডুকেশন।এই স্কলারশিপের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে ও আবেদন প্রক্রিয়া নির্ভুল ভাবে সম্পন্ন করত মেসেজ দিন এখানে

এছাড়া দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্কলারশিপের ব্যাপারে জানতে ও ক্যারিয়ার বিষয়ক গাইডলাইন পেতে ভিজিট করুন এই ওয়েবসাইটে লিডবার্গ এডুকেশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *