খোলা কলম সম্পাদকীয় সর্বশেষ

সবটুকু বিলিয়ে সন্তানকে বড় করে শেষ বয়সে সন্তানের কাছেই বোঝা হচ্ছেন বাবা-মা

 মো. শরিফুল ইসলাম (ছদ্মনাম) অবসরপ্রাপ্ত একজন কলেজ শিক্ষক। দেশ গড়ার তাগিদেই কলেজের অধ্যাপনা শুরু করেন। ২০০৫ সালে তিনি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসরে যান। আমার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন একজন শিক্ষক।
কয়েক দিন আগে স্যারের সঙ্গে দেখা হলো। স্যারকে সালাম দিতেই চিনে ফেললেন। স্যারের কাছে গিয়ে বসলাম। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই অভিমানী মনের অনেক কথা বলে ফেললেন
স্যারের দুই সন্তান। দুজনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তবে দুই সন্তানই ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য প্রায় আট বছর ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। স্যার মনে করছেন, হয়তো আর বাংলাদেশে ফিরে আসবেন না।
দেশে স্যার ও তাঁর স্ত্রী (ম্যাডাম) আছেন। সত্তরোর্ধ্ব এ দুজনই অসুস্থ। দেখাশোনা করার কেউ নেই। স্যার যে পেনশন পান ও যে সঞ্চয় আছে, দুজনের মোটামুটি চলে যায়। কিন্তু বাজার করা, ডাক্তারের কাছে যাওয়া, ব্যাংকের টুকটাক কাজ এই বয়সে স্যারকেই করতে হয়।
ইউটিউব স্ক্রল করতেই সামনে আসলো একটি ভিডিও।  রোগাশয় এক বৃদ্ধের থাম্বনেইল দেখে ক্লিক করলাম। বলতে শুরু করল,
‘আমার সন্তানদের একজোড়া জুতা কিনতে ১০/১২ দিন বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরেছি। মনের মতো, সুন্দর আর বিখ্যাত ব্র্যান্ডের জুতা কিনে দিতাম। তাদের জীবনের যত শখ-সবই পূরণ করেছি।উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। রাজধানীতে তাদের ফ্ল্যাট আছে, প্লট আছে। জীবনের যত সঞ্চয় আছে, আনন্দ আছে-সবই সন্তানদের বিলিয়ে দিয়েছি। এখন একেবারেই নিঃস্ব, বড়ই একা। বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। বৃদ্ধাশ্রম কবরের মতোই। প্রার্থনা করি একটাই-আসল কবরের। আর্তনাত করি-দ্রুত মৃত্যু হলেই বেঁচে যাই।’

কথাগুলো কাঁদো কাঁদো সুরে বলছিলেন রাজধানীর মিরপুরের বৃদ্ধাশ্রমের ৮৭ বছর বয়সি এক অসহায় বাবা।

বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবাকে রাখার একটা বড় অংশ হচ্ছে আমাদের শিক্ষিত সমাজ। এ শিক্ষা কিন্তু আমাদের কাম্য ছিল না? আমাদের সমাজে সুশিক্ষার বড় অভাব। শিক্ষা অর্জন করলেও ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি, যার দরুণ নিজের মা-বাবার পরিচর্যার ব্যাপারে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছেÑ‘পূর্বপুরুষকে নি¤œপুরুষ অনুসরণ করে।’ অর্থাৎ বাবার খাসলত ছেলেও কিছু কিছু পায়। এ থেকে বলতে হয়, ‘কে জানে আজকে যারা তাদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে, তাদের সন্তানরাও সেভাবে তাদের ফেলে আসবে কি না।’ ওই যে পূর্বপুরুষ থেকে শেখা। এভাবে সবাইকে একটা সময়ে বৃদ্ধ হতে হবে। তাই বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে না রেখে তাদের জীবনের শেষ সময়টা পরিবারের সঙ্গে রেখে আনন্দময় করে তোলা উচিত, কারণ বাবা-মা সারাজীবন বেঁচে থাকে না, একবার হারিয়ে গেলে কোনোদিনও আর ফিরে পাওয়া যাবে না এ অমূল্য রত্ন। বৃদ্ধাশ্রম নয়, বরং নিজের বাড়িতেই বসবাসের জন্য স্থান হোক সব বাবা-মায়ের।পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মা-বাবা। কেউ যদি অন্তর থেকে আপনার জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করে থাকেন, তাঁরা আপনার মা-বাবা। আমাদের বড় সমস্যা, মা-বাবা জীবিত থাকতে তাঁদের মূল্যায়ন আমরা করি না। কত বড় ভুলের মধ্যে আমাদের বসবাস! সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কথাটি সবার মনে রাখা উচিত, যাঁর মা আছেন, তিনি কখনো গরিব নন। সেই বিচার-বিবেচনা বোধটুকুও আমাদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যে সন্তানের মা-বাবা পৃথিবীতে বেঁচে আছেন, সময় নষ্ট না করে তাঁদের প্রতি আপনার দায়িত্ব পালন করুন। কারণ আজ যদি আপনি আপনার দায়িত্ব পালন না করেন, তবে সামনের দিনে আপনার প্রতি আপনার সন্তানরাও দায়িত্ব পালন করবে না। প্রকৃতির বিচার বড়ই নির্মম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *