– ইকবাল হোসাইন
ছোট বেলায় একবার আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড় চাচাত ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম।
কোন দেশে যাওয়া যায় সেটা ঠিক করার জন্য আমরা বাজার থেকে একটি পৃথিবীর মানচিত্রের পোস্টার কিনে এনেছিলাম।
তারপর একদিন অলস দুপুরে দুজনে মিলে মানচিত্র খুলে বসেছিলাম, কোথায় যাওয়া যায়। দেখলাম অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকার দিকে যাওয়া যাবে না। কারন, মাঝখানে বিশাল সমুদ্র। কোথায় গেলে ভালো হবে, তা ঠিক করার জন্য আমরা মানচিত্রে বিভিন্ন দেশগুলো দেখতে লাগলাম।
ছোটবেলায় আমরা বিদেশের বিভিন্ন দেশের নাম শুনেছি। তার মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে বেশী শুনতাম জাপানের নাম। যেমন জাপানী ঘড়ি জাপানী টরে কাপড়, জাপানী গাড়ি, জাপান মৈত্রী সেতু ইত্যাদি। জানতাম, জাপান হলো খুব বড়লোক একটি দেশ। সেখানে কোন অভাব নেই, শুধু সুখ আর সুখ। সেটা স্বর্গ না হলেও স্বর্গের মত কাছাকাছি একটা দেশ।
শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা জাপান যাবো। জাপান যেতে হলেও অবশ্য সমুদ্র পারি দিতে হয়। কিন্তু ম্যপে দেখলাম রাশিয়ার উপকুল থেকে জাপান বেশী দুরে নয়। এই পথটি নৌকা নিয়ে বা নৌকা না পেলে সাঁতরে চলে যেতে পারবো। কারন, তখন আমরা ভালো সাঁতার কাটতে পারতাম। আমাদের বাড়ির অদুরে একটি ছোট নদীতে আমরা সাঁতরে অনেকবার এপার- ওপার গিয়েছি। কিন্তু ম্যাপে দেখানো সামান্য একটা বিন্দু বা অল্প একটু দাগও যে কত বিশাল এলাকা হতে পারে তা ওই সময়ে আমাদের অবুঝ মনে কোন ধারনাই ছিল না।
এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, একদিন খুব সকালে বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে যাবো এবং বড় হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে আমরা সবাইকে চমকে দিব। প্রথমে যাবো আমাদের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আখাউড়া। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলা থেকে অরুনাচল প্রদেশের চীনের সিমান্তে। তারপর চীনের নিয়াংচি থেকে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী চীনের হেইহি। সেখান থেকে রাশিয়ার ইভানভকা থেকে নিগির উপকুলে। সেখানে গিয়ে মানচিত্রে দেখানো অল্প একটু পথ সমুদ্র পার হতে পারলেই জাপান।
একটা ভয় ছিল, সীমান্তে পার হতে গেলে পুলিশ কিছু বলবে কিনা? পরে আমরা নিজেদেরকে এই বলে সান্তনা দিলাম যে, আমরা যেহেতু ছোট মানুষ,পুলিশ মনে হয় আমাদের কিছু বলবে না। ছোট বাবু দেখে কিছু না বলে উল্টা আদরও করে দিতে পারে। তাছাড়া আমরা অন্য দেশে গেলে পুলিশের ক্ষতি কি?
আমাদের কাছে যেহেতু কোন টাকা পয়সা নেই, খালি হাতে যাচ্ছি, সেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যাত্রাপথে আমরা কোন গাড়িতে চড়বো না।হেঁটে হেঁটে যাবো।
ওই সময়ে আমরা খুব ভালো হাঁটতে পারতাম। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দুরে ছোট ফুফুর বাড়িতে আমরা অনেকবার হেঁটে গিয়েছি। সেখানে গাড়িতে না গিয়ে হেঁটে যেতাম টাকা বাঁচানোর জন্য, সেই টাকা দিয়ে সেখানে গিয়ে সিনেমা দেখতাম।
আমরা চিন্তা করলাম, জাপান যাত্রাপথে ক্ষুধা লাগলে পথে পথে যেখানেই সুযোগ পাই সেখানেই আমরা কারো কাজ করে দিব। তাতে একদিনের খাবারের টাকা যোগার হলেই পরদিন আমরা সারাদিন গন্তব্যের উদ্দ্যেশে হাঁটবো।রাতে কোন মসজিদ,মব্দির বা স্কুল কলেজের বারান্দায় ঘুমাবো। এটা চিন্তা করার সময় আমাদের একবারও মনে আসেনি, আমাদের যাত্রা পথটা গ্রামের সমতল কোনো মেঠো পথ নয়, দুর্গম। যাত্রা পথে কত নদী-নালা, খাল- বিল, জংগল, পাহার -পর্বত, ও মরুভুমি রয়েছে। রয়েছে হিংস্র প্রানী এবং তার থেকেও ভয়ংকর দুষ্ট লোক।
আমরা তখন বোকার স্বর্গে বাস করতাম। আমাদের গুরুজনেরা আমাদের এইভাবে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনার কথা শুনলে বলতো, এভাবে জাপান যাওয়া যায়না। পড়াশোনা করে যোগ্যতা অর্জন করে বিমানে চড়ে যেতে হয়।
পরে অবশ্য আমরা আমাদের এই উদ্ভট প্লান বাস্তবায়ন করিনি। আমরা যদি এরকম করতাম তাহলে বেশী দুর যেতে পারতাম না। বাড়ি থেকে কিছুদুর গিয়েই হারিয়ে যেতাম এবং কান্নাকাটি করে বাড়ি চলে আসতাম।
যাই বা না যাই, ছোট বেলায় এই রকম চিন্তা করে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম। মনের কল্পনায় দেখতে পেতাম আমরা মনের সুখে হেঁটে হেঁটে কত জনপথ কত এলাকা পার হচ্ছি।তারপর একসময় আমাদের কাঙ্খিত জাপানে পৌঁছে গেছি। ওই সময় কিছুদিন আমাদের নিজেদেরকে অন্য রকম মনে হতো। মনে হতো আমরা সবার থেকে আলাদা। আমরা আর সবার মত সাধারন নই, জাপান চলে যাওয়ার মত অসাধারন কেউ।