সম্পাদকীয় সর্বশেষ

এগিয়ে যাচ্ছে হিমালয়কন্যা পঞ্চগড় জেলা

হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়। দেশের সর্ব উত্তরের এই জেলা গত দেড় দশকে বদলে গেছে। একসময়কার মঙ্গাপীড়িত এলাকা এখন দেশের উন্নয়নের রোল মডেল। জেলার পথে পথে উন্নয়নের ছোঁয়া।

প্রায় ১২ লাখ মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। জেলায় ২০০৮ সালে যেখানে শিক্ষার হার ছিল মাত্র ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ, সেখানে এখন প্রায় ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে খড়ের ঘর। প্রায় প্রত্যেকেরই এখন ইট-সিমেন্টের সুরম্য বাড়ি। অথচ ১৫ বছর আগেও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া একটি পশ্চাৎপদ জেলা ছিল পঞ্চগড়। তিন দিকে ভারত সীমান্তবেষ্টিত এই জেলার নিম্ন আয়ের মানুষ আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গার শিকারে পরিণত হতো। চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অভাব-অনটনে সংসারের বোঝা টানতে হতো। যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল নড়বড়ে

স্থানীয়দের অনেকেই বলতেন, পঞ্চগড় হলো চাকরিজীবীদের জন্য শাস্তিমূলক বদলির জায়গা। কৃষি এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা। নিম্ন আয়ের লোকজন নদীতে পাথর ও বালু উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি হিসেবে পঞ্চগড় চিনিকল খানিকটা সহায়তা করত। অবস্থাসম্পন্ন কৃষকেরা আখ চাষ করে আর্থিকভাবে সচ্ছলতার পথ খুঁজতেন।  বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টিতে সেই পশ্চাৎপদ পঞ্চগড় এখন গোটা দেশে উন্নয়নের রোল মডেল। শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছুতেই এসেছে আমূল পরিবর্তন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য অবদান পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় স্থলবন্দর নির্মাণ। জেলার অর্থনীতিতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেই চলেছে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের মাধ্যমে চার দেশের অর্থনীতির দ্বার খুলেছে। আগে ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির কাজে ব্যবহৃত হতো এটি। বর্তমানে একমাত্র চতুর্দেশীয় এই স্থলবন্দর দিয়ে পঞ্চগড়সহ কয়েকটি জেলার মানুষও যাতায়াত করছে। নেপাল ও ভুটানের মেডিক্যালে কলেজে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এই পথ দিয়ে সহজে যেতে পারছেন। মানুষের যাতায়াত ও পণ্য আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে সরকার। এছাড়া বন্দর ঘিরে ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়ায় এই জেলায় বেকারত্বের হারও কমেছে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে ১৯৯৭ সালে বন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে এবং ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে এই বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০১৬ সালে এই বন্দরে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর চতুর্দেশীয় যাতায়াতব্যবস্থা চালু হয়। এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পাথর, ভুট্টা, খৈল, আদা, গম, চাল, ফল এবং  নেপাল ও ভুটান থেকে উৎপাদিত ও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়া দেশ থেকে পার্টস, গ্লাসশিট, ওষুধ, আলু, জুস, কটন ব্যাগ ও খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে এই বন্দরের কলেবর আরো ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় এটিকে আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি বাংলাদেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় সংযোগস্থল। মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর প্রভাব খুবই উল্লেখযোগ্য। এখানে বন্দরকেন্দ্রিক প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। পঞ্চগড়ের ১২ লাখ মানুষের জীবনমান উন্নতি হয়েছে।

 স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল আলম (৬০) বলেন, ‘কয়েক বছর আগে এই বন্দর নামেই বন্দর ছিল। এত উন্নত ছিল না। আমাদের অনেক দুঃখ ছিল সেই সময়। আমাদের কাছেই ভারত, অথচ এদিক দিয়ে আমরা যেতে পারব না। এখন আমরা যেতে পারছি, এটা হওয়ায় আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে।’

গত শনিবার বেলা সাড়ে ৩টা থেকে বন্দরের বাংলাদেশ অংশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বগুড়ার নোমান খানকে। ঠিক ১৫ মিনিট পর অটোরিকশাযোগে ভারত-বাংলাদেশ জিরো পয়েন্টের সাদা দাগে (সীমানা চিহ্ন) ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে এসে দাঁড়ান এক তরুণী। জোর কদমে হেঁটে গিয়ে তরুণীর ব্যাগ-লাগেজ হাতে নেন নোমান খান। তিনি জানান, ঐ তরুণী ইশানা রায় চৌধুরী তার স্ত্রী। তার বাড়ি ভারতের দার্জিলিংয়ে। প্রেম করে বিয়ে করেন তারা। স্ত্রী ইশানা দুপুরে খেয়ে রওনা দেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছে যান। দুজনের বাড়ি দুই বাংলায় হলেও মাসে কয়েক বার তারা এই বন্দর দিয়ে সহজে যাতায়াত করেন। স্থলবন্দরটির কারণে দুই বাংলার ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়েছে।

চা উত্পাদনে দেশের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পঞ্জগড়। চা খাতে ২০০ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য হয়। ভারতের দার্জিলিংয়ে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন নয়? এই সরল প্রশ্ন থেকে পঞ্চগড়ে চা শিল্পের শুরু হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে প্রশ্নটি করেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেন এটাকে শুধুই একটি প্রশ্ন হিসেবে নেননি। ভারত থেকে চারা সংগ্রহ করে তার বাংলোর একটি টবে রোপণ করে চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তার টবের চারা দ্রুত ডালপালা ছেড়ে বাড়তে থাকে। ২৩ বছর পর পঞ্চগড় জেলায় এখন যেদিকেই তাকানো যায়, দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগান। ২০০৯ সালে এই জেলার মোট চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৫৯ লাখ কেজি, যা ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ কেজি।

গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন :সবুজ প্রকৃতিঘেরা এই জেলার ভূমি অত্যন্ত উর্বর। কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, পর্যটনসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডে গত কয়েক বছরে বদলে গেছে এই জেলার গ্রামীণ চিত্র। সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতাধীন ৭২ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্তকরণের মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে-২-এর উপযুক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০০৮ সাল পর্যন্ত এলজিইডির আওতায় ৩০৫ কিলোমিটর উপজেলা সড়ক নির্মিত হয়। পরে ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে এলজিইডির মাধ্যমে ৭৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৬৯০টি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়, যার ফলে এই জেলায় মোট পাকা সড়কের পরিমাণ হয় প্রায় ১০৯৫ কিলোমিটার, যা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দূরত্বেরও বেশি। একইভাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলায় নির্মিত ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা ছিল ৪৮৮টি (মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ হাজার ৬৮৫ মিটার)। পরে ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে এলজিইডি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাধ্যমে আরো ৪৯২টি বীজ-কালভার্ট (মোট দৈর্ঘ্য ১১ হাজার ৭৪২ মিটার) নির্মাণ করা হয়, যার ফলে মোট ব্রিজ-কালভার্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮০টি (মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩ হাজার ৪২৭ মিটার)। এছাড়া এই জেলায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ভবন নির্মাণপূর্বক ৩৭টি হাটবাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের গৃহ প্রদানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অঙ্গীকার বাস্তবায়নে পঞ্চগড় জেলাই দেশের প্রথম জেলা হিসেবে শতভাগ ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছে।

২০০৬ সালে মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল, যেখানে ২০২৩ সালে ১০০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন দীর্ঘদিন ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ হিসেবে বেঁচে থাকা ছিটমহলে বসবাসের মানুষের স্থায়ী ঠিকানা দিয়ে। ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আওতায় ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে জেলার ৩৬টি ছিটমহলের মানুষ এ দেশের নাগরিকত্বের সুযোগ পেয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পঞ্চগড়ের ৩৬টি ছিটমহলের প্রায় ২০ হাজার মানুষের ৬৮ বছরের বন্দিজীবনের অবসান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এখন তাদের ঘরে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। পেয়েছে স্মার্ট কার্ড। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা। ভাঙা রাস্তাগুলো এখন পাকা সড়ক। সব মিলে পালটে গেছে জেলার ৩৬টি বিলুপ্ত ছিটমহলের দৃশ্যপট।

তথ্যসূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *