বিদ্যালয় বার্তা

পাঠ্যবই নিয়ে বির্তক, ভুলত্রুটি সংশোধনে কমিটি

নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছার পর তাতে নানা ভুল নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলেও শুরুর দিকে চুপ থাকে সরকারের নীতিনির্ধারকরা। পরবর্তীতে পরিস্থিতি সামাল দিতে এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তারা কথা বলতে শুরু করেন।

এ নিয়ে সর্বশেষ আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সেখানে তিনি বলেছেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে ভুলত্রুটি সংশোধন বা প্রয়োজনে তথ্য সংযোজনে কমিটি হবে। একই সঙ্গে ভুলত্রুটির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও কমিটি হবে।

অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, পাঠদানের প্রধান উপকরণ পাঠ্যবইয়ে এমন নানা অসঙ্গতি ভোগাবে শিক্ষার্থীদের; আর বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে শিক্ষকদেরও। পাশাপাশি নতুন পাঠ্যক্রমে ভুলের ফলে তার প্রভাব পড়তে পারে প্রশ্নপত্রের কাঙ্ক্ষিত মানেও।

ভুল মেনে নেওয়ার মতো না উল্লেখ করে তারা বলছেন, আগামীতে যারা এই পাঠ্যবই লেখা বা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে তাদের এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি সরকার ও তৎসংশ্লিষ্টদেরও এ বিষয়ে  সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

নতুন পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল আর বিতর্ক নিয়ে এখন কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে-এমন প্রশ্ন ছিল লক্ষ্মীপুরের প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানের কাছে। জবাবে তিনি জানান, ভুলে ভরা পাঠ্যবইয়ে পাঠদানের সময় শিক্ষকদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের সংশোধনী দিয়ে পাঠদান করতে হয়। তবে এটি বিব্রতকর এবং অনেকক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি এড়াতে কোন কোন শিক্ষক হয়তো এরকম অনেক পাঠ এড়িয়েও যান। আর এখনকার সময়ে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু জানে সেক্ষেত্রে কোন ভুল কিছু পড়ানোর সুযোগ থাকে না। তবে, প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা এড়ানো যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

পরীক্ষামূলক পদ্ধতির বিরোধিতা করে এ শিক্ষক বলেন, আমরা যদি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর পরীক্ষামূলক শিক্ষাক্রম পরিচালনা করি; তাহলে তো তার ফলাফল ভালো আসবে না। আগে শিক্ষাক্রম পূর্ণাঙ্গ করতে হবে, এরপর তা শিক্ষার্থীদের তা দিতে হবে। এছাড়াও শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং যারা প্রশিক্ষণ দেবেন তাদেরও দক্ষতা থাকতে হবে। আমাদের যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাদেরকে আমাদের যথেষ্ট দক্ষ বলে মনে হয়নি। এটি আমার একার উপলব্ধি নয়, আমাদের এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও তা বলেছেন। পাশাপাশি, এতো অল্প সময়ে স্বল্প প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় করোনার সংকটের মাঝেই তাড়াহুড়ো করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে যাওয়ার ফলে একটি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ভুলগুলো ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে এবং তার সমাধানে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষক মনে করেন, আমাদের প্রথমত একটি লেখক প্যানেল তৈরি করতে হবে। তিনি তার কাজের অভিজ্ঞতায় জাপানের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের বিষয়টি সামনে এনে বলেন, তাদের একটি বই দুই বছর মূল্যায়নের পর তা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ফলে তাতে আর কোন ভুলের সুযোগ থাকে না।

“আমার মনে হয় এটি (পাঠ্যপুস্তক) প্রণয়নের বিষয়টি কোন একটি নির্দিষ্ট প্যানেলের মধ্যে না রেখে এটি কনটেন্ট বেইজড (বিষয়ভিত্তিক) দক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে করানো যেতে পারে। ফলে, ভুলের সংখ্যা কমার পাশাপাশি আমাদের পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে। একটি বইয়ে বিশ জন লেখক থাকলে তা কোন সমস্যা না। এটি তিন-চার লেখকের প্যানেলে আটকে থাকা উচিৎ না।”

অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর বলেন, আমাদের এখানে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা বাধ্য হন বা বাধ্য করা হয় বই লিখতে। সবার লেখার মান বা দক্ষতা সমান না হওয়ার পাশাপাশি সকল বিষয়ে সবার সমান ইন্টারেস্ট (আগ্রহ) থাকে না। সেক্ষেত্রে যখন আমাদের প্যানেল নির্দিষ্ট করা থাকে বা তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না তখনই ভুল হতে থাকে; সেজন্য এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হতে হবে।

“প্রক্রিয়াটি আমাদের রিভিউ করতে হবে। আর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে না দিয়ে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। লেখকদের পর্যাপ্ত রিসোর্স (প্রয়োজনীয় উপকরণ) দিতে হবে। তাহলেই পাঠ্যপুস্তক নির্ভুল করে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে পারবো। আর প্রশ্নপত্রের বিষয়টি বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই আমরা আশা করতে পারি যে, ভুল এড়ানো যাবে।”

পাঠ্যপুস্তকে ভুলের বিষয়টি আমলে নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, যেসব ভুল রয়েছে তার সংশোধনী ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি অনলাইনে এবং এনসিটিবির ওয়েবসাইটেও দেয়া হয়েছে; যেখানে সারা দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের সংযুক্তি রয়েছে। আমরা তাদের একটি ইন্সট্রাকশন (নির্দেশনা) দিয়েছি।

“ভুলের বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি যেসব শিক্ষকরা ভুল করেছেন এবং প্লেজিয়ারিজমের (চৌর্যবৃত্তি) সাথে জড়িত তাদের আগামীতে পাঠ্যপুস্তক এবং তৎ-সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত করা হবে না।”

অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আমাদের শিক্ষা-বিজ্ঞানের রীতি-নীতি মেনে কাজ করতে হয়। দেশে এখন সবাই যে যার মতো করে মতামত দিচ্ছে। আমরা সবার মতামতই শুনছি; বোঝার চেষ্টা করছি, সুযোগ থাকলে গ্রহণও করছি। কিন্তু, আলাদা করে সবার জন্য তো কাজ করা বা বই তৈরি করা সম্ভব নয়। আমরা বই চূড়ান্ত করার আগে ও পরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলি; তাদের মতামত, পছন্দ-অপছন্দগুলোও শুনি। বড় কোন ভুল থাকলে আমরা তাড়াতাড়ি তার সংশোধনী দিয়ে থাকি। আর যা বিশ্বের সবদেশেই হয়ে থাকে; আগে বই দেয়া হয়-পরবর্তীতে তা চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান মনে করেন, এসব ভুলের বিষয়ে তাদের আরও সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ভাবছি পাঠ্যপুস্তক চূড়ান্ত করার আগে তার মিনি ট্রাই আউট (পরীক্ষামূলক) কপি করার বিষয়ে। ফলে, পাঠ্যবইয়ে ভুলের সংখ্যা কমবে।

আর প্রশ্নপত্রে এর কোন প্রভাব পড়ার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সংশোধনী দিয়েছি; তাই সে ধরনের কোন বিষয় ঘটবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *