খেলাধুলা

বাংলাদেশকে ‘সুপারফ্যান’ হিসেবে যেভাবে দেখে আর্জেন্টিনা

নিজের দেশ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেললে নিঃসন্দেহে সে দেশের মানুষের শতভাগ তারা পাবে। জনপ্রিয় ও দক্ষতায় নিপুণ, এমন দলের হাজারো সমর্থক দেশের সীমানার বাইরে থাকবে, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আর্জেন্টিনার মতো এমন উদাহরণ কমই আছে, যেখানে দেশটির মোট জনসংখ্যার চাইতেও বড় ভক্তকুল রয়েছে ভিন্ন একটি দেশে। পৃথিবী নামের গ্রহে আর্জেন্টিনার অবস্থান যেখানে তার একেবারে উল্টো পাশে অবস্থিত সেই দেশটির নাম বাংলাদেশ।

ফলে রোববার (১৮ ডিসেম্বর) ফাইনালে আর্জেন্টিনা দল যখন মাঠে নামবে নিজের দেশের মানুষের সাথে হাজার হাজার মাইল দূরের এক দেশের মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে মাঠে নামবে মেসির দল। মেসিদের কৃতিত্ব যাদের উদ্বেলিত করবে, মাঠের উত্তেজনায় যাদের স্নায়ু টান টান হয়ে উঠবে, মাঠে মেসিদের ব্যর্থতা যাদের কাঁদাবে। ব্যাকুল এই ফুটবলপ্রেমী দেশটি ইতিমধ্যে আর্জেন্টিনার ‘সুপারফ্যান’র তকমা পেয়েছে।

আর্জেন্টিনার সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশ

আর্জেন্টিনা থেকে প্রকাশিত স্প্যানিশ এবং ইংরেজি ভাষার সব ধরণের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশি ভক্তদের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বড় পর্দায় খেলা দেখার পাশাপাশি আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে মিছিল, আর্জেন্টিনার জার্সি পরে মোটর শোভাযাত্রা করা, আর্জেন্টিনার পতাকাশোভিত ভবন বা আকাশী-সাদায় আঁকা সড়ক নিয়ে নানা ছবি এবং ভিডিওর খবর দেখা গেছে।

সর্বশেষ শুক্রবার আর্জেন্টিনার ফুটবল বিষয়ক সংবাদমাধ্যম এআরজি সকার নিউজ দুইটি ছবি দিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছে, যেখানে এক বাংলাদেশি নাপিতের দোকানের দুটো ছবি দিয়েছে। ছবিতে গ্রাহকের চুল-দাড়ি যারা কাটছেন, যাদের চুল-দাড়ি ছাটা হচ্ছে তাদের ঢেকে দেয়া কাপড় আর অপেক্ষমাণ গ্রাহক বয়সে যারা শিশু-সবার গায়ে সাটা আর্জেন্টিনার পতাকা।

দোকানে এককোণে আর্জেন্টিনার একটি পোস্টার, যাতে বাংলায় লেখা ‘খেলাধুলাই পারে শিশুকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে’।

বাংলাদেশি ভক্তদের করা নানা রকম ভিডিও টুইটারে পোস্ট করেছে আর্জেন্টিনার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, আর সেগুলো দেখেছেন লাখ লাখ ব্যবহারকারী। সাথে সম্প্রতি ভারতের সাথে বাংলাদেশের ওডিআই সিরিজের খবর দিতে দেখা গেছে দেশটির গণমাধ্যমে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমর্থনে ইতিমধ্যে ফেসবুকে ‘ফ্যানস আর্হেন্তিনোস দে লা সিলেকসিয়ন দে ক্রিকেট দে বাংলাদেশ’ নামে খোলা হয়েছে একটি গ্রুপ। বাংলায় যার মানে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আর্জেন্টাইন সমর্থক’ নামে গ্রুপটি খুলেছেন ড্যান লানডে নামে আর্জেন্টিনার একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।

গ্রুপটিতে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ মানুষ সদস্য হয়েছেন, আর্জেন্টাইনদের সাথে এখন গ্রুপে অনেক বাংলাদেশি সদস্যও রয়েছেন।

বুয়েনোস আইরেস থেকে ড্যান লানডে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশি বিভিন্ন গ্রুপে আর্জেন্টিনার খেলা বা পতাকা নিয়ে উন্মাদনার কথা তিনি শুনেছিলেন, যেখানে লাখ লাখ মানুষ সেগুলো দেখেন। শুরুতে সেখান থেকে ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই ঢুঁ মেরেছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, পরে ভাবলাম, কেন আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটা গ্রুপ খুলি না! আমি ভেবেছিলাম বড়জোর ১০০ বা ২০০ মানুষ যুক্ত হবে এই গ্রুপে। কিন্তু গ্রুপ খুলে ফেসবুকে শেয়ার করার প্রথম মিনিটেই বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে কয়েকশো মানুষ যোগ দেন তাতে। কেউ কেউ তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে গানও বাধেন। বিষয়টা আমাদের মধ্যেই ছিলো, যতোক্ষণ না বাংলাদেশি কেউ বিষয়টা সম্পর্কে জানতে পারলেন।

একদিনের মধ্যে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার, এক সপ্তাহের মধ্যে সদস্য সংখ্যা হয় এক লাখ ৭০ হাজার। কিন্তু এখন গ্রুপটি পাবলিক থেকে প্রাইভেট করে দেয়া হয়েছে।

খেলোয়াড়দের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা

বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি পাল্টা সমর্থন দেখিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পেজ খুলেছেন আর্জেন্টাইনদের অনেকে। বুয়েনেস আইরেসে খেলা দেখতে জড়ো হওয়া দর্শকের হাতে আর্জেন্টিনার পাশেই উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা এবং টুইটার-ফেসবুকে শত শত আর্জেন্টাইনের প্রোফাইলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার ইমোজি।

এখন বলাই যায়, ১৮ই ডিসেম্বর লিওনেল মেসি যখন কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবেন, তখন আর্জেন্টিনার পাশাপাশি থাকবে যেন বাংলাদেশও।

আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্ট দেয়া হয়েছে।

পয়লা ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বাংলাদেশি সমর্থকদের তিনটি ছবি দিয়ে ওই পোস্টটিতে লেখা হয়, ‘আমাদেরকে সমর্থন দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।’ এরপর লেখা হয়েছে, ‘ওরা আমাদের মতোই পাগল।’

এখানেই শেষ নয়, এক প্রাক ম্যাচ সংবাদ সম্মেলনে ‘সমর্থনের জন্য’ বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কাকোনি।

সর্বশেষ আমেরিকান ভিডিও লাইভ স্ট্রিম টুইচে সার্জিও অ্যাগুয়েরোর এক লাইভে, যেখানে মেসিও উপস্থিত হয়েছিলেন, সেখান থেকে তাদের বাংলাদেশি ভক্তদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, বলে খবর দিচ্ছে খেলাধুলা বিষয়ক বার্তা সংস্থা বিআর ফুটবল।

আর্জেন্টিনার সরকারের স্বীকৃতি

লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার সাথে বাংলাদেশের ভৌগলিক দূরত্ব ১৭ হাজার মাইল। দুই দেশের মধ্যে এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোন ফ্লাইট নেই। দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি আর আচারেও মিল সামান্যই, তবু ফুটবলই তাদের নৈকট্যের একমাত্র অনুষঙ্গ।

গত সপ্তাহেই আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো কাফিয়েরো ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশের সাথে নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় তার দেশ।

ধারণা করা হয়, এর পেছনে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তার দেশের ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশি সমর্থকদের অকুণ্ঠ সমর্থন। আর্জেন্টিনার প্রতিটি জয়ের পর যা কেবল বেড়েছেই।

এদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এর আগে বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি, ভৌগলিক অবস্থান, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের ‘গ্রোয়িং ইমপরট্যান্স’ এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। সেই সাথে ফুটবল একটি বাড়তি উপাদান যোগ করেছে। এবং এটা খুবই আনন্দের যে তিনি (আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বিষয়টিকে এখন সামনে নিয়ে এসেছেন।

আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। ব্রাজিলে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে আসা হচ্ছিলো, বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী মি. আলম।

আর্জেন্টিনা ঢাকায় দূতাবাস স্থাপন করলে সেটি হবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনো লাতিন দেশের দূতাবাস।

কীভাবে আর্জেন্টিনার ‘সুপারফ্যান’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ?

আর্জেন্টাইন ফুটবল দলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের এই সমর্থনের বয়স নিদেনপক্ষে ২৬ বছর। ম্যারাডোনা থেকে শুরু, মেসিতে এসেও থামেনি সেই উন্মাদনা। কিন্তু ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে একেবারে শেষের দিকে থাকা একটি দেশ, যাদের অবস্থান আফ্রিকার দেশ সামোয়া আর জিবুতির মাঝখানে, তারা কেন আর্জেন্টিনার ফুটবল অন্তঃপ্রাণ সমর্থক? এর সোজা জবাব দিয়েগো ম্যারাডোনা।

বাঙালীর ফুটবল প্রীতির ভরকেন্দ্র মূলত লাতিন আমেরিকা, সেখানকার অলিগলি থেকে উঠে আসা শৈল্পিক ফুটবলের বন্দনা এ অঞ্চলে দশকের পর দশক ধরে চলছে। শুরুতে যার মূল আকর্ষণ ছিলো ব্রাজিল। কিন্তু ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ২৫ বছর বয়সী এক অপ্রতিরোধ্য ফুটবলারের নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতার সাথে সাথে ম্যারাডোনা মুহূর্তে পরিণত হন বাংলাদেশি মানুষের নতুন ফুটবল ঈশ্বরে।

আর্জেন্টিনার সমর্থক গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর বাসিন্দা মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ম্যারাডোনা যখনই বল পায়ে পেতো, উদ্ধত ভঙ্গিতে খেলতো। আমরা দারুণ উদ্দীপনা পেতাম। একটা বিশ্বকাপে উনি এমন এক জাদু দেখালেন যে আমরা এখনো মুগ্ধ হয়ে আছি।

বাংলাদেশে রঙ্গিন টিভি আসার পর সেটাই ছিলো প্রথম বিশ্বকাপ, ফলে পর্দায় ম্যারাডোনার ক্রোধ, হতাশা আর উচ্ছ্বাস সচিত্র দেখেছেন বাংলাদেশের মানুষ। সেসময় যারা শিশু, আজ তারা মধ্যবয়সে এসেও আর্জেন্টিনার প্রতি সমর্থন ধরে রেখেছেন, যদিও মাঝের প্রায় দুই দশকের বেশি সময় আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে সাফল্য পায়নি।

পরের প্রজন্ম যারা কেবল বিশ্বকাপের আসরই নয়, ইউরোপীয়, স্প্যানিশ আর ইংলিশ ফুটবলের দর্শক এবং নিয়মিত খেলোয়াড়দের খোঁজখবর রাখেন, তারা ম্যারাডোনার জায়গায় নিজেদের ভালোবাসা সমর্পণের নুতন তারকা খুঁজে পেয়েছেন, লিওনেল মেসি।

বাংলাদেশে এখন মেসি আর আর্জেন্টিনা যেন সমার্থক শব্দ। মসিউর রহমানের ছেলে নাফির প্রিয় তারকাও মেসি। কিন্তু এ বছর বিশ্বকাপ শুরুর পর ঢাকায় ড্রোন দিয়ে তোলা মেসির এক গোল উদযাপনের ভিডিও যখন ফিফার ওয়েবসাইটে ঠাঁই করে নেয়, সেটি ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজুড়ে। তারই কল্যাণে আর্জেন্টিনার মানুষও এবারই প্রথম বাংলাদেশে নিজেদের এতো শক্ত জনপ্রিয়তার ব্যাপারে জানতে পেরেছে।

আর প্রায় সাথে সাথে দেশটির পক্ষ থেকে সেজন্য স্বীকৃতি, কৃতজ্ঞতা আর সমর্থনও ফিরে আসতে শুরু করেছে।

যাদের নিয়ে এতো উচ্ছ্বাস, সেই মেসির দল, দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, আর্জেন্টিনার সরকার, সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, সাধারণ নাগরিকসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের ‘ক্রেইজি’ বা পাগল ভক্তদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে। খবর: বিবিসি বাংলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *