বিশ্ব বিদ্যালয় সাজেশন

তিন বন্ধুর সিজিপিএ একই, যুক্তরাষ্ট্রে বৃত্তি নিয়ে পিএইচডির সুযোগও পেলেন একসঙ্গে

মো. মামুনুর রশিদ, মো. সুমন আলী ও মো. নাঈম হোসেন তিন বন্ধু। ক্যাম্পাসে তাঁদের মানিকজোড় বলতেন সহপাঠীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে যা কিছু করতেন সব সময় তিনজন মিলেই করতেন। একই সঙ্গে পড়াশোনা করা, থিসিস পেপার করা ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিও নেন। তিনজনের চিন্তাভাবনা ও পড়াশোনায় অনেক মিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো বিবিএ ও এমবিএতে তিনজনের সিজিপিএ একই। এমনকি এসএসসি ও এইচএসসিতেও তাঁদের জিপিএ একই। বিবিএ ও এমবিএতে ভালো ফল করে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি পেতে শুরু করেন প্রস্তুতি। এ বছর তিনজনই যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন। আসছে আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন তাঁরা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ করেছেন তিন বন্ধু। তিনজনের সিজিপিএ বিবিএতে ৩.৮৪ ও এমবিএতে ৩.৯৩।

মো. মামুনুর রশিদ ফিন্যান্স বিষয়ে ফুল ফান্ড নিয়ে পিএইচডি করতে যাচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট সান আন্তোনিওতে। মো. সুমন আলী ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট এল পাসোতে ফিন্যান্স বিষয়ে বৃত্তিসহ পিএইচডির সুযোগ পেয়েছেন এবং মো. নাঈম হোসেন ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিন্সে ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিকসে পিএইচডি করতে যাচ্ছেন।

মো. সুমন আলী একটি পিএইচডি ও একটি মাস্টার্সের ভর্তির বৃত্তিসহ অফার পেয়েছিলেন, নাঈম হোসেন মাস্টার্স, পিএইচডিসহ মোট চারটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারটি অফার পেয়েছেন এবং মামুনুর রশিদ বৃত্তিসহ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে একটি বেছে নিয়েছেন।

মো. মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ফুল স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাওয়ার জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। শুধু মেধাবী হলেই হয় না, ধৈর্য ধরে লেগে থাকার মানসিকতা আগে প্রয়োজন। আমাদের তিনজনের কথা যদি বলি, প্রত্যেককেই একাধিকবার আইইএলটিএস ও জিআরই পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। কারণ, প্রথমবার আবেদনের জন্য আমরা কাঙ্ক্ষিত স্কোর পাইনি।’

মো: নাঈম হোসেন বলেন, ‘বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রতিযোগিতামূলক অ্যাডমিশনে সুযোগ পেতে হলে দরকার সামষ্টিক একটা প্রোফাইল। বিশেষ করে বিজনেসের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি আরও জরুরি। কোনো ফ্যাক্টরই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, যেমন সিজিপিএ, পাবলিকেশন, জিআরই, প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতা, আইইএলটিএস, রিকমেন্ডেশন লেটার, স্টেটমেন্ট অব পারপাস ইত্যাদি। যাঁরা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, তাঁদের উচিত অনার্স দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বর্ষ থেকেই এসব বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করা। প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করলে আরও ভালো হয়। নিজের প্রোফাইল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করা উচিত। দেখা গেল আপনার প্রোফাইল মডারেট লেভেলের, সে ক্ষেত্রে আপনি হার্ভার্ড বা এমআইটিতে আবেদন করলেন, আপনার আবেদন রিজেকশনের হার অনেক বেশি থাকবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস পিএইচডি প্রোগ্রামগুলো তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়, ফিন্যান্স প্রোগ্রামগুলো আরও বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ। কারণ, তারা বছরে একবারই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্টুডেন্ট নেয়, তা–ও আবার মাত্র ২-৩ জন, কিছু কিছু প্রোগ্রামে একজনও নেয়, যেখানে বিশ্বের নামীদামি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবেদন করে থাকেন। এই তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ পেতে কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের তিনজনের উচ্চ জিআরই ও আইইএলটিএস স্কোর ছিল না। তবুও আমরা মনোবল হারায়নি। আমরা আমাদের গবেষণাপত্রগুলোকে ভালোভাবে ফোকাস করার চেষ্টা করেছি। আমাদের সিজিপিএ নিয়েও কোনো ঝামেলা ছিল না। কারণ, তিনজনের সিজিপিএই ভালো। আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে রিকমেন্ডেশন লেটার ও স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি)। বিশ্বের বিভিন্ন নামীদামি গবেষকের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তাঁদের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন এবং আরও কিছু দেশের গবেষকের কাছ থেকে আমরা রিকমেন্ডেশন লেটার নিতে পারি। এসওপিতে আমরা যথেষ্ট সময় দিয়েছি। আমরা নিজেরা লিখেছি, তারপর আমেরিকাতে যাঁরা পিএইচডি করতেছেন, তাঁদের কাছ থেকে আমাদের এসওপি রিভিউ করিয়ে নিয়েছি।’

মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমার জন্য এ সাকসেসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ থেকে খুব কম শিক্ষার্থী আমেরিকায় ফিন্যান্সে পিএইচডিতে সুযোগ পান। ফিন্যান্সের পিএইচডি প্রোগ্রামগুলো খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়, সেখানে একই বিশ্ববিদ্যালয়, একই বিভাগ ও তিন বন্ধু একসঙ্গে পিএইচডিতে সুযোগ পাওয়া অনেক গর্বের। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো তিন বন্ধু একসঙ্গে পিএইচডি শুরু করা, যেখানে আমরা তিনজনই একসঙ্গে অনার্স চতুর্থ বর্ষ থেকেই গবেষণা শুরু করি। এখানে আমাদের তিনজনের সুপারভাইজার বখতিয়ার হাসান স্যারের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। উনি না থাকলে হয়তো আমরা এই স্বপ্ন দেখার সাহস পেতাম না। মায়ের দোয়াও সব সময় সঙ্গে ছিল।’

বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে যাঁরা নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য পরামর্শও দিয়েছেন এই তিন শিক্ষার্থী। তাঁরা বলেন, ব্যবসা অনুষদের পিএইচডি প্রোগ্রামগুলো খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়। প্রতিবছর সর্বোচ্চ দুই-তিন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। আইইএলটিএস স্কোরের কথা যদি বলি, চেষ্টা করবেন ৭ ব্যান্ড তোলার। কারণ, এতে আপনার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সুযোগ তৈরি হবে। ৬.৫ হলেও সমস্যা নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ৬.৫–এ গ্রহণ করে। জিআরইর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এখানে ৩১০–এর ওপরে তুলতে পারলে আপনি প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা রাখেন। এর পাশাপাশি যদি সিজিপিএ ভালো হয়, তাহলে আপনার সুযোগ অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

রিসার্চ পাবলিকেশনের বিষয়ে তিন বন্ধু বলেন, পিএইচডি আবেদনের ক্ষেত্রে রিসার্চের গুরুত্ব অপরিসীম। ভালো মানের কিছু পাবলিকেশন আপনাকে অন্য প্রার্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রাখবে। আমাদের রিসার্চ পেপার থাকার কারণে আমরা অনেক এগিয়ে ছিলাম। তৃতীয় অথবা চতুর্থ বর্ষ থেকে চেষ্টা করবেন গবেষণার কাজে নিয়োজিত হওয়ার। আপনার বিভাগের যে শিক্ষক গবেষণার কাজে অ্যাকটিভ, তাঁর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সব সময় কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করুন।

যেহেতু তিনজনের ফল ও সবকিছুতে অনেক মিল, তাই ভবিষ্যতে তিনজন মিলে উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. সুমন আলী বলেন, ‘আমাদের তিনজনেরই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মোটামুটি একই। আমাদের ইচ্ছা আমরা তিনজনই ভালো মানের গবেষক হব। আমাদের গবেষণায় সোসাইটি, ইকোনমি ও ফিন্যান্সিয়াল মার্কেটে প্রভাব থাকে, সে রকম গবেষণা আমরা ভবিষ্যতে করতে চাই। তা ছাড়া আমরা ফিন্যান্সের অধ্যাপক হতে চাই, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ডায়নামিক শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধসহ তাদের ভালো মানের শিক্ষার্থী তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে চাই। পিএইচডি শেষ করার পর আমরা একটা বিজনেস রিসার্চ ইনস্টিটিউট চালু করতে চাই, যেখানে বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরা ভালো মানের গবেষণার কাজে যুক্ত থাকবে।’

সূত্র: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *