পশ্চিম ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এবং বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো জাতি-রাষ্ট্রের একটি হলো ফ্রান্স। ফ্রান্সের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতির পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। উন্নত জীবনযাত্রা, শক্তিশালী অর্থনীতি ও মানসম্মত সময়োপযোগী শিক্ষার পরিবেশ থাকায় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ইউরোপের এই দেশ। তাই প্রতি বছর প্রচুর বিদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণে পাড়ি জমাচ্ছে ফ্রান্সে।
ফ্রান্সে যেসব বিষয়ে অধ্যায়ন করা যায়ঃ-
প্রোগ্রামসমূহঃ- সাধারণত ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ,স্নাতকোত্তর,ডিপ্লোমা, পিএইচডি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শর্ট-কোর্স করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও এমবিএ এবং মেডিসিন বিষয়েও পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে ফ্রান্সে। সাধারনত স্নাতক কোর্সে চার বছর এবং স্নাতকোত্তর কোর্সের মেয়াদ এক বছর এবং অন্যান্য কোর্স বিভিন্ন মেয়াদে পরিচালিত হয়ে থাকে।
বিষয়সমূহঃ- ইকোনমিক্স, সোস্যাল এডমিনিস্ট্রেশন, আর্টস, হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি, হেরিটেজ অ্যান্ড ট্যুরিজম, ল’, কম্পিউটার সায়েন্স, জিওলজি, বায়োলজি, ফিজিক্স, লিটারেচার, মেডিক্যাল সায়েন্স, ফার্মেসি, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন সায়েন্স, ইনফরমেশন সায়েন্স, ফিলোসফি, মিউজিক, আরবান প্ল্যানিং, বিজনেস স্টাডিজ, ইলেকট্রনিক্স, এনাটমি, রেডিওলজি, ফার্মাকোলজি, ভিডিও অ্যান্ড মিডিয়া, বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ আরও অনেক বিষয়ে এদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ রয়েছে।
ফ্রান্সে বছরে তিন সেমিস্টারে কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে।এখানে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আর শেষ হয় মে-জুন মাসে।
• ১ম সেমিস্টার শুরু হয় সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে।
• ২য় সেমিস্টার শুরু হয় জানুয়ারী- ফ্রেরুয়ারী মাসে এবং
• ৩য় সেমিস্টার শুরু হয় মে-জুন মাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া
ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদনের সময়সীমা নির্ধারিত থাকে। এখানে বছরে তিনটি সেমিস্টার পড়ানো হয়ে থাকে। আবেদনকারীকে নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পছন্দকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি বা বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েব সাইটের মাধ্যমে ভর্তির আবেদন করতে হবে। আবেদনকারী যোগ্য বিবেচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ পরবর্তিতে শিক্ষার্থীর করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে দেবে। অবেদন প্রক্রিয়া,আবেদনের সময়সীমাসহ বিস্তারিত তথ্যের জন্য অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে নজর রাখতে হবে।
ফ্রান্সে পড়াশোনার জন্য ভাষা
সাধারনত ফ্রান্সের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফ্রান্স ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে । তবে বেশ কিছু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবার ইংরেজি শিক্ষা লাভের সু্যোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হবে। প্রয়োজন হবে IELTS বা TOFEL SCORE এর । সাধারণত স্নাতকের জন্য ৫-৫.৫ IELTS স্কোর এবং ৫৫০ Tofel স্কোর অন্যদিকে স্নাতকোত্তরের জন্য ৬.০০ IELTS স্কোর এবং ৬০০ Tofel স্কোর থাকতে হবে। তবে আপনার কোর্স যদি ফ্রেঞ্চ ভাষায় হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষতার প্রমাণপত্র দিতে হবে। আর এজন্য আপনার যোগাযোগ করতে হবে Alliance Francaise -এ। আর সেখান থেকে করে ফেলতে হবে ফ্রেঞ্চ ভাষার ওপর কোর্স। আপনি যদি কম খরচে ফ্রান্সে অধ্যায়ন করতে চান তাহলে ভাষা আপনার জন্য অন্যতম একটি উপাদান হিসেবে কাজ করবে।
যোগ্যতাসমূহঃ-
• ফ্রান্সে স্নাতক ডিগ্রির জন্য এইচ.এস.সি পাশ হতে হবে ।
• স্নাতকোত্তরের জন্য স্নাতক পাশ হতে হবে।
• পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য অবশ্যই আপনার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী থাকতে হবে।
• একাডেমিক ফলাফল ভালো থাকতে হবে ।
• ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হবে ।
অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজি পারদর্শিতা যাচাই করার জন্য অনলাইন টেস্ট বা স্কাইপিতে ইন্টারভিউ নিয়ে থাকে।
প্রয়োজনীয় নথিপত্রঃ-
ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে নথিপত্রের তারতম্যে হয়ে থাকে । তাই আপনার পছন্দকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে হবে ।
• পাসপোর-জন্মনিবন্ধন-জাতীয়তা সনদ-এর কপি।
• ছবি ।
• আবেদন পত্র।
• সকল একাডেমিক পরীক্ষার মূল সনদ ও মার্কশিট এর কপি।
• আইইএলটিএস/টোয়েফল এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষতার সনদ।
• মোটিভেশন লেটার/ রেফারেন্স লেটার/ সিভি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)
টিউশন ফি
ফ্রান্সে বেশি ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বার্ষিক ফি বাবদ ৩-৪ লক্ষ টাকা দিতে হয়। ফ্রান্সে সাধারনত একজন শিক্ষার্থীর থাকা খাওয়া বাবদ মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা লাগে। যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম খরচ হয় পড়াশোনা করার জন্য। ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক কোর্সে পড়তে আনুমানিক ২৭৭০ ইউরো প্রতি বছরে খরচ হয়ে থাকে।আর স্নাতকোত্তর কোর্সে ৩৭৭০ ইউরো প্রতি বছর এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য ৩৮০ ইউরো প্রতি বছরে আনুমানিক খরচ হয়ে থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে টিউশন ফি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
আপনার আবেদন গৃহীত হলে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত টিউশন ফি প্রদান করতে হবে।
স্কলারশিপ
ফ্রান্সে ফুল-ফ্রিতে বা আংশিক অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অধ্যায়নের জন্য রয়েছে নানা ধরনের স্কলারশিপ। স্কলারশিপগুলো সাধারণত সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক হয়ে। এসব স্কলারশিপে আংশিক বা পুরো টিউশন ফি মওকুফ হতে পারে। কিছু কিছু স্কলারশিপে মাসিক ভাতাও প্রদান করা হয়ে থাকে। স্কলারশিপের তথ্য জানতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অফিসিয়াল ওয়েসাইটে নজর রাখতে হবে ।
ব্যাংক সলভেন্সি
ফ্রান্সে ভিসার ক্ষেত্রে ব্যাংকে আপনাকে ১০ থেকে ১৫ হাজার ইউরো দেখাতে হবে। যে ব্যক্তি আপনাকে ব্যাংক স্পন্সরশিপ বহন করবেন, সে যদি প্রথম রক্তের সম্পর্কের অভিভাবক হন, তাহলে ভিসার ক্ষেত্রে আপনি সুবিধা পাবেন। এছাড়া অন্য যেকোনো অভিভাবক আপনাকে স্পন্সর করতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনাকে সঠিক কাগজপত্র ও প্রমাণাদি এম্বাসিতে জমা করতে হবে। আপনি চাইলে নিজের নামেও ব্যাংকে টাকা দেখাতে পারেন। ভিসা পাবার পর আপনি চাইলে এই টাকা যেকোনো সময় তুলে নিতে পারবেন। আপনি অফার latter পাওয়ার পর টাকাটা ব্যাংকে রেখে দূতাবাসে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। তারপর ভিসা হলে আপনি টাকাটা তুলে নিতে পারবেন। ফ্রান্সে প্রবেশকালে যদি immigration এ জানতে চায়। আপনার কাছে পর্যাপ্ত পরিমানে টাকা আছে কিনা তাদের দেশে পড়াশোনা করার মত। তখন তাদের কে ব্যাংক solvency নমুনা দেখাতে হবে।
পার্ট টাইম জব
কম খরচে পড়াশোনা করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ফ্রান্সে পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করতে হবে। ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী একজন বিদেশি শিক্ষার্থী বছরে সর্বোচ্চ ৯৪৪ ঘন্টা কাজ করতে পারবে। আর এখানে ফুল টাইম কোর্সের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজ করতে পারবে। তবে ছুটি ও অবসর সময়ে ফুল টাইম কাজ করা যায়। যা মাসে প্রায় ৮০০-১০০০ ইউরো আয় করা যায়। ফ্রান্সে পড়াশোনা শেষ করে জব খোঁজার জন্য এক বছরের ভিসা পাবেন। এই ভাবে আপনি ফ্রান্সে কম খরচে পড়াশোনা করতে পারবেন।
স্থায়ী বসবাসের সুযোগ
পড়াশুনা শেষ করার পর আপনি ফান্সে ১ বছর চাকরি খোঁজার জন্য সময় পাবেন। আর আপনি যদি হয়ে থাকেন তরুণ গবেষক, কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বা ইনোভেটিভ ইকোনমিক প্রোজেক্টের ডিজাইনার, ফ্রেঞ্চ টেক প্রোগ্রামের অংশ গ্রহণকারী, আর্টিস্ট, উচ্চ পর্যায়ের অ্যাথলেট তাহলে আপনার জন্য ইস্যু করা হবে Plurennial Residence Card (“Passeport Talent”) – এই কার্ডটির আওতায় আপনি ও আপনার পরিবারকে ৪ বছরের ভিসা দেওয়া হবে, আর এই সময়ে আপনি চাকরি করতে পারবেন। ফান্সে একটানা ৫ বছর বৈধভাবে থাকার পর শর্ত সাপেক্ষে স্থায়ী বসবাসের (পিআর) জন্যে আবেদন করতে পারবেন। সব শর্ত রক্ষিত হলে পেয়ে যাবেন ফ্রান্সের নাগরিকত্ব।
ফ্রান্সে ভিসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রঃ-
• পাসপোর্ট। (অবশ্যই ৬ মাসের অধিক মেয়াদ থাকতে হবে)।
• জন্ম নিবন্ধনের কপি ।
• জীবনবৃত্তান্ত।
• সকল একাডেমিক ডকুমেন্টস।
• ইউনিভার্সিটির অফার লেটার।
• আইইএলটিএস/টোয়েফল এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষতার সনদ
• অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ও পাসপোর্ট সাইজের ২ কপি।
• ফ্লাইট বুকিং টিকেট (এটা করতে কোনো টাকা লাগে না, শুধু বুকিং দিবেন)।
• ভিসা অ্যাপ্লিকেশান ফি বা স্কলারশিপ লেটার (যদি পেয়ে থাকেন। স্কলারশিপ প্রাপ্তদের ফি লাগে না)।
• হেলথ ইস্যুরেন্স (যতদিন এর কোর্স ততদিনের করতে হবে)।
• ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সল্ভেন্সি (যিনি আপনার সকল খরচ বহন করবেন তার অর্থাৎ স্পন্সরের)।
• হাউজিং সার্টিফিকেট/ ডকুমেন্ট (যদি ফ্রান্সে কোন আত্মীয়ের বাসাকে হাউজিং এর জন্য দেন তাহলে ঐ শহরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সত্যায়িত উনার/উনাদের বাসার সকল কন্ট্রাক্ট পেপার দেখাতে হবে)।
• স্পন্সরের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট কপি, যা দ্বারা আপনার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি টিউশন ফি পরিশোধের কপি/প্রমাণপত্র।
• ট্রেনিং সার্টিফিকেট। (প্রয়োজন সাপেক্ষে )
• কাজের অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট । (প্রয়োজন সাপেক্ষে)
কেন যাবেন ফ্রান্সে
ফ্রান্সের শিক্ষার মান খুবই উন্নত এবং এর ডিগ্রি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ফ্রান্সের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাশকিং এ এগিয়ে রয়েছে। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত ফ্রান্সে শিক্ষা গ্রহণের পর আছে বিশ্বব্যাপী ক্যারিয়ার গড়ে তোলার সুযোগ। অনেক বছর ধরেই ফ্রান্স গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, জেনেটিকস, পদার্থবিদ্যা এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ের জন্য বিখ্যাত।