কলেজ বার্তা বিদ্যালয় বার্তা

স্বাধীনতার ৫১ বছর, শিক্ষার প্রসার বাড়লেও কমেছে গুণগত মান

সরকারি হিসাবে বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দাঁড়িয়ে দেশের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নানা সূচকে উন্নতি হলেও কতটুকু উন্নতি হয়েছে দেশের সামগ্রিক শিক্ষায়?

দেশের শিক্ষা ও তৎসংশ্লিষ্ট খাতে উন্নতির মাপকাঠি বিচার করলে শিক্ষার পরিমাণগত উন্নতি হলেও গুণগত উন্নতি খুব বেশি হয়নি-বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে প্রায় ৩৫ কোটি বই দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এছাড়া পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে বৃত্তি ও উপবৃত্তিসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। সার্বিক সূচকের হিসেবে উন্নতি উর্ধ্বমূখী হলেও নিম্নমুখী দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি ও শিক্ষিতদের দক্ষতা কিংবা সাফল্যের সূচক। ফলে, অর্জন কেবলই পরিমাণগত।

দেশে বর্তমানে শিক্ষা কেবলই চাকরি পাওয়ার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। তরুণরা শিক্ষা এমনকি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও চাকরি পাচ্ছে না। যার ফলে তারুণ্যের হতাশা আর বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির বেহাল দশা। এর প্রমাণ বর্তমানে আমাদের পাঠ্যক্রমে পড়ানো হচ্ছে বা জোর দেয়া হচ্ছে এমন সব বিষয়ে, যাতে সহজে চাকরি পাওয়া যায়।

যদিও এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। তাদের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তাঁরা চাকরি পাবেন না। গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। এছাড়া চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ। অর্থাৎ কেবল চাকরির জন্য শিক্ষা মাধ্যমের অঘোষিত যাত্রাও সাফল্য পাচ্ছে না প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী দক্ষতার অভাবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ (দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ) শিরোনামের তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মহামারিকালে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে তরুণ বেকারদের সংখ্যা। তাদের তথ্য বলছে, দেশে তরুণদের মাঝে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে এ হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদনের প্রাথমিক তথ্যবিশ্লেষণ বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ তরুণ সংখ্যার হিসেবে যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১। তাদের সবার বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছর।

বৈশ্বিক মহামারী, মন্দা, যুদ্ধসহ নানা কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত তরুণদের লড়াই করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। তথ্য বলছে, প্রচলিত ব্যবস্থায় বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিবিএস-এর  জরিপ বলছে, দেশের বেকার তরুণদের মধ্যে সবাইই কর্মক্ষম বেকার। যদিও আইএলওর প্রতিবেদনে বলছে, দেশে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মিলিয়ে মোট বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ্য করে সংস্থাটি।

আর অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এতে বড় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পরোক্ষ অপচয় মেধা, সময় আর তরুণদের উদ্যমের। ফলাফল আমাদের শিক্ষা মাধ্যম তরুণদের আশা বাঁচিয়ে রাখতে পারছে না। তথ্য বলছে, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, চায়না ৫০ বছর আগেও উন্নতির সূচকে বাংলাদেশের সম-পর্যায়ে ছিল। আর কিউবা তাদের স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মাথায় শিক্ষার হার শতভাগ নিশ্চিত করতে পেরেছে। তাহলে আমাদের যা পরিমাণগত বৃদ্ধির তাও মান বিচারে না হওয়ার পাশাপাশি সন্তোষজনক নয় চলমান পরিমাণেরও।

পরিসংখ্যান মতে, পাঁচ দশকের একটি পরিণত বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আর এ সময়ে আমাদের জনমিতিতে যে পরিবর্তন, তার সুফল পেতে আমাদের বর্তমান তরুণদের জন্য জন্য আশা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামোয় শক্তিশালী ভিত দাঁড় করাতে হলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বৃদ্ধি করতে হবে প্রচলিত দক্ষতারও। জনমিতিতে পরিবর্তন ও সময়ের সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বর্তমান প্রজন্মকে বর্তমান সময়ের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি দক্ষ হতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে আমাদের গুনগত শিক্ষায়, নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষা। পাশাপাশি উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাসে। একইসাথে আমাদের ‘সফট স্কিল’ অর্থাৎ ন্যায়বোধ, মানবিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে সবার মাঝে। আমাদের সকল স্তরের শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

যার ফলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস কাঙ্ক্ষিত হয়নি জানিয়ে লেখক, প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার গুণগত মান আমরা বাড়াতে পারিনি; পরিমাণগত বাড়িয়েছি। এর নিদর্শন হলো যারা আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে ত্রুটি রয়ে গেছে। যেমন ইতিহাসের চর্চা কমে গেছে; ইতিহাসকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *