বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সর্বশেষ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

কালাজ্বর শনাক্তের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের দাবি ঢাবি অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের

রক্ত কিংবা পরীক্ষার আরও জটিল প্রক্রিয়া এড়িয়ে সহজে কালাজ্বর শনাক্তের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের দাবি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ; যে পদ্ধতিতে প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা যাবে।

একই সঙ্গে এটিকে কার্যকরী এবং নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে পরজীবীবাহিত রোগ কালাজ্বর শনাক্তকরণের রোগীবান্ধব পদ্ধতি বলে দাবি করছে গবেষক দলটি।

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ মনজুরুল করিম।

তিনি জানান, অস্থি মজ্জা, যকৃত, প্লীহা, লিম্ফ নোডের টিস্যু পরীক্ষার মত জটিল পদ্ধতি এড়িয়ে কিংবা রক্ত পরীক্ষার পরিবর্তে প্রস্রাব পরীক্ষা করে বেলে মাছির মাধ্যমে ছড়ানো কালাজ্বর শনাক্ত করা যাবে।

এ পদ্ধতিতে মূত্রের নমুনা ব্যবহার করে আরটি-পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যে মাত্র আধা ঘণ্টায় কালাজ্বর শনাক্ত করে তিন ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক মনজুরুল।

তিনি জানান, এর আগে এ রোগ নির্ণয়ে রক্তের ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক পরীক্ষা এবং অস্থি মজ্জা, যকৃত, প্লীহা, লিম্ফ নোড এর টিস্যু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হত, যার প্রথমটির রোগ নির্ণয়ে নির্দিষ্টতা কম এবং অন্যটিতে টিস্যু সংগ্রহের সময় মারাত্মক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বিদ্যমান।

কালাজ্বর লিশম্যানিয়া ডনোভানি নামের এককোষী পরজীবীবাহিত একটি রোগ। বাংলাদেশে এটির বাহক স্ত্রী বেলেমাছির কামড়ে কালাজ্বরের পরজীবী মানুষের দেহে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে সংক্রামক রোগের তালিকাতেও রয়েছে এটি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে এটি উপেক্ষিত একটি রোগ; যার মধ্যে লিশম্যানিয়াসিস তিনটি রূপের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতি। কালাজ্বরের সংক্রমণ এতটাই গুরুতর ও মারাত্মক যে, যথাসময়ে চিকিৎসা করানো না হলে এ রোগে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যু হয়ে থাকে। বাংলাদেশে একমাত্র লিশম্যানিয়া ডনোভানি পরজীবীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

অধ্যাপক মনজুরুল বলেন, ৭৮টি দেশে এ রোগের সংক্রমণ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে।

বাংলাদেশের ২৬টি জেলার ৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ রোগের ওষুধ থাকলেও শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটা জটিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে এ রোগ নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়েছে। রোগ নির্মূলের জন্য জরুরি সঠিক শনাক্তকরণ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে করা কালাজ্বরের ‘মলিকিউলার ডায়াগনস্টিক’ পদ্ধতিতে ক্লিনিকাল নমুনা হিসেবে প্রস্রাব ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রথম।

২০১৪ সাল থেকে প্রায় ৭ বছর গবেষণা করে এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ক্লিনিক্যালি শনাক্ত করা ২৩ জন রোগীর প্রস্রাবের নমুনা থেকে গবেষণার ফলাফল পাওয়া যায়। এ গবেষণা প্রবন্ধ গত ২৯ ডিসেম্বর পিএলওএস গ্লোবাল পাবলিক (https://doi.org/10.1371/journal.pgph.0000834) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা দলে রয়েছেন- সাইমুর রহিম, মো. মহিউদ্দিন শরীফ, এমডি. রোবেদ আমিন, মোহাম্মদ তারিকুর রহমান ও মুহাম্মদ মনজুরুল করিম।

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক মনজুরুল বলেন, “বিগত দশকে বেশ কিছু পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) ভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় প্রক্রিয়া প্রচলিত হয়েছে। যদিও এ প্রক্রিয়া পূর্বে ব্যবহৃত পদ্ধতি হতে রোগ নির্ণয়ে অধিক কার্যকারী। এই সকল প্রক্রিয়ায় রক্ত, অস্থি-মজ্জা, যকৃত, প্লীহা, লিম্ফ নোড এর টিস্যু এর নমুনা ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় কিডনিতে লিশম্যানিয়ার দেহের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে, তাই আমরা প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এবং রিয়েল টাইম পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যে কালাজ্বর শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি।”

এ পদ্ধতিতে দ্রুততার সঙ্গে শনাক্ত করা সম্ভব হওয়ায় রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি।

তার আশা এ পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশকে কালাজ্বর নির্মূলের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

“প্রস্রাবের নমুনা ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে যে উল্লেখযোগ্য সংবেদনশীলতা এবং নির্দিষ্টতা পাওয়া গিয়েছে, তা রক্ত বা আরও জটিল নমুনা যেমন অস্থি-মজ্জা বা প্লীহা এর নমুনাভিত্তিক কালাজ্বর নির্ণয় পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে,” যোগ করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান উদ্ভাবনের জন্য গবেষক দলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের অনেক গবেষক ও বিজ্ঞানী রয়েছেন। নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে তাঁরা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

আধুনিক ও সমৃদ্ধ ল্যাব স্থাপন করা গেলে শিগগির এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোভিড ১৯ টিকাসহ বিভিন্ন ধরনের টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদন করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটো মিঞা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ কে এম মাহবুব হাসান, চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. শাহরিয়ার নবী, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সূত্রঃ bdnews24.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *