বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়

আইসিপিসির ওয়ার্ল্ড ফাইনালের পর্দা নামলো ঢাকায়, চ্যাম্পিয়ন এমআইটি

ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা নামলো ‘আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস ঢাকা’র জমকালো আয়োজনের। বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবেই ঘোষণা করা হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবেই শেষ হলো প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের জন্য সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই আন্তর্জাতিক আয়োজনের বাংলাদেশ অধ্যায়ের। সমস্ত আয়োজন শেষে এবার বাংলাদেশের হিসাবের খাতা খোলার পালা। প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ আসর থেকে কতটুকু অর্জন দেশের এবং দেশের দলগুলোর?

আইসিপিসি ৪৫তম আসরে বাংলাদেশের ৮টি দল মোট সমস্যা সমাধান করে ১৮টি। এরমধ্যে,  বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ৪টি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(শাবিপ্রবি) ৪টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়(ঢাবি) ৩টি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়(এনএসইউ) ২টি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়(জাবি) ২টি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি(এআইইউবি) ১টি, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ১টি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি) ১টি সমস্যার সমাধান করে।

এ আসরে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা দলগুলোর অবস্থানে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ৫১তম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ৫৬তম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়(ঢাবি) ৮২তম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়(জাবি) ৯৮তম, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়(এনএসইউ) ১০৭তম, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি(এআইইউবি) ১১৩তম, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি) ১১৯তম এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ১২২তম অবস্থানে রয়েছে। যদিও গত ৪৪ তম আসরে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এশিয়া পশ্চিম অঞ্চলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। যেহেতু ৪৫তম আসরে বাংলাদেশের হয়ে ৮টি দল ছিল এবং বাংলাদেশেই এবারের আসর তাই সবারই প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ ভালো কিছু অর্জন করবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতের ফলাফল বলছে ভিন্ন কথা। গুণগত কিংবা পরিমাণগত যা-ই হিসেব করা হোক না কেন বাংলাদেশের প্রাপ্তি কেবলই বড় আসর আয়োজনের এবং অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা অর্জন।

৪৫তম আসরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ও আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস ঢাকার পরিচালক অধ্যাপক কামরুল আহসান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা ৮টি দলই সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে; যা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। যেটি সম্ভব হয়েছে প্রথমবার দেশে বিদেশি কোচের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে। প্রশিক্ষণ প্রদান একটি বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিলো বলেও মনে করেন তিনি। এর পাশাপাশি জানান ঢাকায় আইসিপিসির ৪৫তম আসর আয়োজনের ফলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আরও বেশি প্রোগ্রামিংয়ে তথা সমস্যা এবং সমস্যার সমাধানে উদ্বুদ্ধ হবে।

অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, আইসিপিসি চায় তাত্ত্বিক থেকেও প্রায়োগিক দিকে শিক্ষার্থীরা জোর দিবে এবং নিজেদের আগামীদিনের জন্য প্রস্তুত করবে। প্রথমে বাংলাদেশের চারটি টিম অংশগ্রহণ কারার কথা থাকলেও পরে আইসিপিসি থেকে আরও চারটি বোনাস স্লট পাওয়ার কারনে মোট আটটি টিম অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। তিনি জানান বাংলাদেশে নিয়মিত প্রোগ্রামিং এবং এ সংক্রান্ত আয়োজনে আরও বেশি জোর দিলে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা আরও ভালো করবে। পাশাপাশি সকলে মিলে কাজ করলে আগামীদিনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হয়ে গড়ে উঠবে। সেজন্য তিনি দেশি ও বিদেশি বড় মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এধরনের আয়োজন আরও বেশি করতে হবে এবং আরও অংশগ্রহণের পাশাপাশি দলগুলো এবং যারা আগ্রহী তাদের প্র্যাকটিস(অনুশীলন) করতে হবে বলেও জানান তিনি

আর অংশগ্রহণকারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের(জাবি) শিক্ষক ও অংশগ্রহণকারী দলের সহকারী কোচ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম জানান, কভিডের কারনে আমাদের প্র্যাকটিস(অনুশীলন) কম হয়েছে। তারপরও অনলাইনে এবং ক্যাম্পেইনসহ অন্যান্য মাধ্যম মিলিয়ে পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

জাবির এই শিক্ষক আগামী দিনে তাদের দল বিশ্ব আসরে জয় নিয়ে আসবে এমন আশাবাদ জানিয়ে বলেন, এবারই প্রথম আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ দেখেছি; এটি আমাদের সূচনা। তিনি বলেন, আমদের দেশ প্রথম থেকে প্রোগামিং খুব বেশি করা হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা উচ্চশিক্ষায় এসে শুরু করা হয়, যার কারনে আমরা খুব বেশি সাফল্য পায়না। সেজন্য পাঠ্যসূচিতে আইসিটি শিক্ষাকে আরও বেশি ব্যবহারিক ও সমস্যা সমাধান ভিত্তিক করতে হবে এবং স্কুল ও কলেজ-ভিত্তিক প্রোগামিংয়ে জোর দিতে হবে বলেও জানান তিনি।

প্রোগ্রামিংয়ের অলিম্পিয়াড খ্যাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্টের (আইসিপিসি) এবারের চূড়ান্ত পর্বের (ওয়ার্ল্ড ফাইনাল-২০২২) আয়োজক হয়েছে বাংলাদেশ। সারা বিশ্ব থেকে ১৩৭টি দল এই বছরের ওয়ার্ল্ড ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রতিযোগিতাটি উদযাপন করতে ৭০টি দেশ থেকে এক হাজার ৬শ’রও বেশি অতিথি ঢাকায় আসেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের নেতৃত্বে আইসিপিসি এর ৪৫তম আসরের নির্বাহক বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এবং বাংলাদেশের থেকে হোস্ট ইউনিভার্সিটি ‘ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)’।

মূল প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীরা ছয় ঘণ্টাব্যাপী বিভিন্ন প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান করেন। আর পরীক্ষা পরিচালনা করে আইসিপিসির বিচারক পর্ষদ। পুরো প্রতিযোগিতা হয় ইন্টারনেটযুক্ত কম্পিউটারে।

সবচেয়ে বেশি ১২টির মধ্যে ১১টি সমস্যা সমাধান করে ফাইনাল বিজয়ী হয় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। একইসাথে উত্তর আমেরিকারও আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। তারা চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পেয়েছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, সনদ এবং ১৫ হাজার ডলার

এবারের আসরে ১০টি সমস্যা সমাধান করে দ্বিতীয় হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত কিউএস এশিয়ান ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং ২০২৩ এ প্রথম চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি (বেইজিং)। একইসাথে তারা এশিয়া পশ্চিম অঞ্চলেরও চ্যাম্পিয়ন। ৯টি সমস্যা সমাধান করে তৃতীয় টোকিও ইউনিভার্সিটি। পাশাপাশি তারা এশিয়া প্যাসিফিকে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন। ৯টি সমস্যা সমাধান করে চতুর্থ সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। পাশাপাশি এ চারটি দল আসরের স্বর্ণজয়ী দল।

৯টি সমস্যা সমাধান করে পঞ্চম ইটিসি জুরিখ; একইসাথে তারা ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন। ইকোল নর্মালে সুপেরিন্তি ডি প্যারিস ষষ্ঠ, কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি সপ্তম, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারসো অষ্টম এবং এরা আসরের রৌপ্যজয়ী।

ন্যাশনাল রিসার্স ইউনিভার্সিটি হায়ার স্কুল অফ ইকোনোমিকস দক্ষিণ ইউরেশিয়া চ্যাম্পিয়ন এবং আসরের নবম, আসরে দশম সেইন্ট পিটার্সবার্গ স্টেস্ট ইউনিভার্সিটি, একাদশ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, দ্বাদশ ইউনিভার্সিটি  অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি(ভিএনইউ)। তারা সবাই আসরের ব্রোঞ্জজয়ী।

ফলাফল ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ মান্নান । অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইসিপিসি ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং আইসিপিসি নির্বাহী পরিচালক ড. উইলিয়াম বি. পাউচার।

অন্যান্যদের মধ্যে আইসিপিসির উপনির্বাহী পরিচালক ও আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস কনটেস্ট এর পরিচালক ড. মাইকেল জে. ডোনাহু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ও আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস ঢাকার পরিচালক অধ্যাপক কামরুল আহসান এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এর নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

মূলত, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হলো আইসিপিসি। আইসিপিসি আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের বেলর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে আইসিপিসি ফাউন্ডেশন।

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এ ইভেন্টের আয়োজন করছে এবং চীন, জাপান এবং থাইল্যান্ডের পর বাংলাদেশ এশিয়ার মাত্র চতুর্থ দেশ যারা এ ইভেন্টের আয়োজক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। আইসিপিসির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭০ সাল থেকে। যদিও ১৯৭৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ আয়োজনের দায়িত্বে ছিল কম্পিউটারের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অন্যতম বৃহৎ ও পুরোনো প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি (এসিএম

উল্লেখ্য, আইসিপিসি প্রতি বছর দু’টি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। ১ম পর্বে বিশ্বের ৮টি অঞ্চল থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিজয়ীরা চূড়ান্ত (ওয়ার্ল্ড ফাইনাল) পর্বে অংশ নেয়। আইসিপিসি, ঢাকা বিশ্বের ৮টি অঞ্চলের মধ্যে এশিয়া-পশ্চিম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের ৮টি অঞ্চল থেকে আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ী দলগুলো এবছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইসিপিসি এর চূড়ান্ত পর্বে (ওয়ার্ল্ড ফাইনাল) অংশ নেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *