খেলাধুলা

পেলে সর্বকালের সেরা হলো যে কারণে

না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ফুটবলের রাজা পেলে। বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ৮২ বছর বয়সে মারা গেলেন ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি।

সাও পাওলোর দারিদ্রপীড়িত বস্তিতে জন্ম পেলের। সেখানকার রাস্তায় মোজা মুড়িয়ে বল বানিয়ে কিংবা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতেন। ঠিক খেলতেন নয়, খেলার পাশাপাশি জাদুকরি সব মুহূর্তের জন্ম দিতেন ওই অল্প বয়সেই। পরিবারের একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও ছিলো না।

কিন্তু ১৫ বছর বয়সে সেই ছেলেটিই সান্তোসের মূল দলে গোলের পর গোলের মালা গেঁথেছেন। ১৬ বছর বয়সে খেলেছেন ব্রাজিল জাতীয় দলে। আর ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ৬ গোল করে ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। হয়ে গেলেন সর্বকণিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী! কিন্তু সেটা কেবলই পেলের শুরু।

যখন শেষ করেছিলেন, ততোদিনে পৃথিবীতে তার মতো আর কেউ নেই। তিনবার বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার। আর একমাত্র ফুটবলার হিসেবে এক হাজার গোলের মালিক (তর্কযোগ্য)।

১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে রাজনৈতিক কারণে ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচের পদ থেকে ছাঁটাই হওয়া হোয়াও সালদানাকে ব্রাজিলের এক ক্রীড়ালেখক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ব্রাজিলের সেরা গোলকিপার কে?’ সালাদানা বলেছিলেন, ‘পেলে।’

সেই ক্রীড়ালেখক পাল্টা জানতে চান, ‘বেশ, তাহলে সেরা রাইটব্যাক?’ এবারো উত্তর এলো ‘পেলে।’ মোটামুটি দলের অর্ধেক পজিশনে পেলের নাম বলার পর সালাদানা খানিক হেসে বলে ফেলেন, ‘পেলে যেকোনো পজিশনেই বিশ্বের সেরা ফুটবলার।’ পেলের সঙ্গে ও বিপক্ষে খেলা অনেকেই সালদানার সুরেই কথা বলেছিলেন।

১৯৫৮ বিশ্বকাপের আগে পেলে চোট পেয়েছিলেন। তার সতীর্থরাই চাপাচাপি করে পেলেকে সুইডেন বিশ্বকাপে নিয়ে যান। সেই বিশ্বকাপে পেলে ৬টি গোল করেন। ফাইনালে জোড়া গোল করেছিলেন। ম্যাচ শেষে আনন্দের আতিশায্যে মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন ১৭ বছর বয়সী পেলে। জ্ঞান ফেরার পর প্রতিপক্ষ (সুইডেন) দলের খেলোয়াড় সিগভার্দ পার্লিং পেলেকে বলেছিলেন, ‘তোমার দ্বিতীয় গোল দেখে করতালি দিতে ইচ্ছে করছিলো।’

১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলে চোটের কারণে দুই ম্যাচের বেশি খেলতে পারেননি। সেবার ব্রাজিলকে জেতালেন গারিঞ্চা। পরের বিশ্বকাপেও কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে পেলে বিদায় নিলেন প্রথম রাউন্ড থেকে। ব্রাজিলও বিদায় নেয় তার সঙ্গে। এই চোটের কারণেই ১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলের খেলার কথাই ছিলো না। কিন্তু এই বিশ্বকাপেই ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র পাসটি ছিলো তার পা থেকে। ‘শতাব্দীর সেরা ফুটবলার’র সিগনেচার পাস ছিলো সেটি। ইতালির বিপক্ষে সেই ফাইনাল ৪-১ গোলে জিতেছিলো ব্রাজিল।

এই ম্যাচে পেলেকে মার্ক করার দায়িত্ব ছিলো ইতালির ডিফেন্ডার তারচিসিও বারজিনিচের ওপর। তিনি বলেছিলেন, ‘ফাইনালের আগে আমি নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, সে (পেলে) আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ। আমি ভুল ভেবেছিলাম।’

সান্তোস, ব্রাজিল ও নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে মোট ৪০ ট্রফি জিতেছেন পেলে। তিনি ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার মিলে ফুটবলের ভিত গড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। উয়েফার সভাপতি থাকতে মিশেল প্লাতিনি একটা মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফুটবলার পেলে ও মানুষ পেলে। কিন্তু পেলে যখন ফুটবল খেলেছেন তখন তিনি ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন।’

ইতিহাসই সে কথা বলে। সেটা শুধু ১৩৬৬ ম্যাচে ১২৮২ গোলের জন্য নয়, প্রতিভার দ্যুতিতে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য্ও নয়। বরং খেলাটির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সেটা পৃথিবীর মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও পেলের কোনো তুলনা নেই। একটা খেলায় একজন অমর কিংবদন্তির কাছ থেকে লোকে আর কি আশা করতে পারে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *