আর ৪ দিন পর তথা (২৯ জুন) বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে পালিত হবে মুসলামনদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আযহা। এই ঈদের আনন্দ কিছুটা ভিন্নরকম। বাড়ির মুরুব্বী- বয়োজ্যেষ্ঠ, যুবক, কিশোর সবাই মিলে একত্রে হাটে যাওয়া, সেখানে যেয়ে বেপারী বা খামারীদের সাথে পশু নিয়ে দামাদামি, সবাই একসাথে টানাটানি করে কুরবানীর পশুকে নিয়ে আসা কখনো বা দড়ি ছিড়ে দৌড়, কাউকে বা দিয়ে বসে শিং দিয়ে একটি ঢুস ,শত ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে বাসায় এসে খড় – ভুসি খাওয়ানো, গরমের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করা, রাত জেগে গরু পাহারা দেওয়া এরকম কতধরনের কান্ডকীর্তি ! সারাজীবন গ্রামে না যাওয়া কখনো হাত দিয়ে খড়-ঘাস না ধরা, কিংবা কখনো গরুর গোবরে পাড়া না দেওয়া শহরের মডার্ন ছেলেটিও যেন কয়দিনের জন্য পুরোদস্তর রাখাল হয়ে উঠে। কুরবানী করার আগ পর্যন্ত যেন চলে এই উদ্দীপনা ও আমেজ। এই আনন্দ উত্তেজনায় আমরা প্রায়ই কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে ভুলে যাই, যাতে যাতে করে প্রায় সময় আমাদের মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে। মাঝে মাঝে আনন্দ রূপ নেয় বিষাদে। একাডেমিক ডায়েরীর পাঠকদের উদ্দ্যেশে আজ আমরা চেষ্টা করব কুরবানীর সময় পালনীয় কিছু সতর্কতা তুলে ধরতে যা মাথায় রেখে চললে পাঠকগন নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে উপভোগ করতে পারবে ঈদের আনন্দ।
১.কুরবানীর পশু ক্রয় করতে হাটে যাওয়ার সময়
কুরবানীর জন্য পশু ক্রয় করতে হাটে যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় কুরবানীর আমেজ, বলা যায় এটি আনন্দের প্রথম ধাপ। বছরে মাত্র একবারই এই সুযোগ আসে বিধায় বাড়ির ছোট, বড়, বয়োঃবৃদ্ধ, মহিলা, কন্যা সবারই আগ্রহ থাকে পশু কিনতে হাটে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে কুরবানীর হাটের দূরত্ব, হাটের ভিতর পশু ও মানুষের চাপ, গরম আবহাওয়া এসব বিবেচনায় যারা শক্তি, সামর্থ্য ও সুস্থবান তাদের নিয়েই হাটে যাওয়া উচিত।
ছোট শিশু কিংবা অনেক বয়স্ক লোকদের হাটে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিহার করা ভালো। কেননা ছোট বাচ্চাদের চঞ্চল স্বভাবের দলছুট হয়ে হারিয়ে যেতে পারে কিংবা ঘটতে পারে মারাত্নক দুর্ঘটনা। বয়স্ক লোকরা হাটের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে না পারায় পড়তে হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে। মহিলা বা মেয়েদের বেলায়ও খাটে একি কথা।
হাটে যাওয়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে কেডস বা শ্যু জাতীয় জুতা পরিধান করে যেতে যাতে পায়ের আঙ্গুল গুলো রক্ষা পায়। কেননা মানুষের পায়ের পাড়া বা পশুর পায়ের পাড়ায় নিজের পায়ে ব্যাথা, নখ ভাঙা কিংবা আঙ্গুলও ভেঙ্গে যেতে পারে।
২.কোরবানীর হাটের ভিতর সতর্কতা
হাটে প্রবেশের পর নিজের চোখ কান সর্বদা খোলা রাখতে হবে, সর্বাবস্থায় সতর্ক থাকতে হবে। কারন এসময় অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, পকেটমার এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। দামী ঘড়ি, মোবাইল, নগদ টাকা এসবের দিকে সর্বক্ষন নজর রাখতে হবে। টাকার পরিমান খুব বেশি হলে সঙ্গে নেওয়া লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিলে কিছুটা নিরাপদে থাকা যায়।
হাটে ভিতরে প্রবেশ করার আগে একটি পানির বোতল সাথে করে নিতে হবে। চাইলে বিস্কুট, চিপস, রুটি এধরনের হালকা খাবার নিয়ে ঢুকতে হবে, কারন অনেক সময় পছন্দমতো কুরবানির পশু পেতে অনেক সময় লাগে তখন খিদে পেলে এসব খাওয়া যাবে, কেননা হাটের ভিতরে দোকান থাকে না।
৩.সঠিকভাবে কুরবানীর পশু ক্রয়
কুরবানীর জন্য সর্বদা সুস্থ, তরতাজা ও বলবান পশুকে বেছে নিতে হবে। অন্ধ, রোগাক্রান্ত,জীর্নশীর্ন অবস্থা বা কোনধরনের অঙ্গহানি রয়েছে এমন পশুকে কোরবানির জন্য ক্রয় ও কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
গরু, ছাগল বা মহিষের দাঁত দেখে বয়স ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে, বাঁধা অবস্থা থেকে খুলে কিছুক্ষন হাটিয়ে পশুকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে তারপরই দামাদামি বা ক্রয় করার জন্য আগানো উচিত।
৪.কোরবানির পশু ক্রয় করার পর
পছন্দমতো কোরবানি পশু ক্রয় করা হল খামারী বা বেপারীকে দাম পরিশোধের পর খামারী বা বেপারীকে নিয়ে হাসিল ঘরে যেয়ে হাসিল পরিশোধ করে তার রশিদ সংরক্ষন করতে হবে। হাট থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত এই হাসিল রশিদ সংরক্ষন করত হবে।
৫.কোরবানির পশু নিয়ে হাট থেকে বের হওয়ার সময় সতর্কতা
কোরবানির পশু নিয়ে হাট থেকে বের হওয়ার সময় শক্তি, সামর্থ্যবান ও স্বাস্থ্যবান লোকদেরকে গরুর দড়ি ধরতে হবে। গরুর মাথার দিকে দড়িকে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ লোকের হাতে দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই গরু বা মহিষ যেন দড়ি ছেড়ে দৌড়াতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
হাটিয়ে বাসায় আনার সময় রাস্তায় পশুকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দিতে হবে। তাকে বেত্রাঘাত, জোরে থাপ্পর কিংবা জোরাজুরি করা যাবে না। কুরবানির পশুর প্রতি অবশ্যই মানবিক হতে হবে।
৬.কোরবানির পশু বাসায় আনার পর সতর্কতা
বাসায় নিয়ে এসে তাকে শক্ত কিছু যেমন বাসার গেট, পিলার এসবের সাথে শক্ত করে গিট দিয়ে বেধে দিতে হবে যাতে কোনভাবেই পশু দড়ি ছিড়তে না পারে। তাকে খড়, ভুসি, কাচা ঘাস, পানি খাওয়াতে হবে। পরিস্কার জায়গায় রাখতে হবে, প্রয়োজনে মশার কয়েল বা ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭.কোরবানির পশুর নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্কতা
ঢাকা শহরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেকে রাস্তার উপর কোরবানি পশু রাখে এতে চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে চেষ্টা করতে হবে গেটের ভিতর রেখে গেট বন্ধ রাখতে, আর রাস্তার উপর রাখলে অবশ্যই পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কোনভাবেই কোরবানির পশু চুরি না যায়।
৮.কোরবানির সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা
কোরবানির দিন ও এর আগের রাতে গরুকে বেশি খাবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে পরিমানমতো পানি দিতে হবে। কোরবানির আগে গরুকে গোসল করাতে হবে। কোন পশুর সামনে অন্য পশুকে কোরবানি দেওয়া মানবিকভাবে সমীচীন নয়। চেষ্টা করতে হবে একটি পশুর আড়ালে অন্য পশুকে কেরবানি দেওয়ার জন্য
কোরাবনি করার জন্য গরুকে নিচে শোয়ানের দায়িত্ব অবশ্যই অভিজ্ঞ লোকদের দিতে হবে। পশুকে শোয়ানের পর অবশ্যই তার হাত পা একত্রে শক্ত করে বেধে দিতে হবে, যাতে জবাই করার সময় লড়তে না পারে। জবাই করার সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে যাতে সহজে ও দ্রত জবাই কাজ সম্পন্ন হয়। একাজ অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে সম্পন্ন করাতে হবে।
৯.গোশত প্রক্রিয়া করনের সময় সতর্কতা
জবাই করার পর কেরবানির পশু সম্পন্ন নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। পুরোপুরি নিস্তেজ হওয়ার কিছুক্ষন পর চামড়া আলাদা করতে হবে
চামড়া আলাদা ও গোশত প্রক্রিয়ার সময় অবশ্যই ছুরি, চাপাটি, বটি এসব ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে শরীরের কোন অংশ বা আঙ্গুল কেটে না যায়। প্রয়োজনে আঙ্গুলে কাপড় পেচিয়ে নিতে হবে। রক্ত লেগে হাত পিচ্ছিল হয়ে গেলে হাতে আটা ময়দা মাখিয়ে নিতে হবে।
১০. গোশত বন্টনের সময় সতর্কতা
গোশত প্রক্রিয়াকরনের পর গরীব অসহায়দের মধ্যে গোশত বিতরন করতে হবে, অনেকে শুধু মাত্র হাড্ডি,লেজ কিংবা খাবার অনুপযোগী মাংস বিতরন করে কিন্তুু তা ঠিক নয়, তাদেরও ভালো গোশত বিতরন করতে হবে। গরীব দুঃস্থদের জন্য একটি ভাগ করতে হবে। এবং সবাই যেন কিছু পরিমান হলেও পায় সেই উপায়ে বিতরন করতে হবে।
কোরবানি প্রতি বছরে একবারই আসে বিধায় ছোটখাটো অনেক জিনিসই আমাদের মাথায় থাকে না। তাই আমাদের এসমস্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি কোরবানীর পশুর প্রতি আমাদের মানবিক হতে হবে। এবং কোরবানিকে শুধু আনন্দ বা উৎসবের মধ্যে না রেখে মানবজীবনেও এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,
আল্লাহর কাছে গোশত ও রক্ত(কোরবানির পশুর) পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوٰى مِنكُمْ ۚ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلٰى مَا هَدٰىكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ
অর্থঃ এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।
[আল হাজ্জ্বঃ আয়াত নং ৩৭]