বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ালেখার আদ্যপান্ত

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ব্যক্তিগত জীবনসহ কর্মক্ষেত্রের সকল পর্যায়েই কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। সাড়া বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও ক্রমেই বাড়ছে কম্পিউটার নির্ভরতা। ফলে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষারও প্রসার ঘটছে প্রতিনিয়ত। ক্রমান্বয়ে বিশ্বব্যাপী সিএসই বা কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদেরও আগ্রহ বাড়ছে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই ‘সিএসই’ বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। অনেকেই এ বিষয়ে পড়ালেখা করে ভালো ক্যারিয়ার গড়ছেন, চাকরি করছেন গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সিএসইতে পড়ায় আগ্রহ বাড়ছে তরুণদের। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখার ক্ষেত্রে সাবজেক্ট চয়েজের ক্ষেত্রে সিএসইকে প্রাধান্য দিচ্ছে তারা।

ফলে ‘সিএসই’ বিষয়টি কেমন, ভালো ক্যারিয়ার গঠনে এ বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কোন কোন ধরনের কোর্স পড়ানো হয় সিএসইতে, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সিএসই থেকে কতটা সুবিধা করা যায়, কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই পড়ানো হয়, এর ব্যয়-ই বা কেমন- এরকম অনেক প্রশ্ন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের।

এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতেই এই প্রতিবেদন:

১. সিএসই কি

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘সিএসই’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা যায়। সাধারণত তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কোর্সের সমন্বয়ে সিএসইর কোর্সটি চার বছর মেয়াদী হয়ে থাকে।

২. কারা পড়বে সিএসই

সিএসই একটি সৃজনশীল বিষয়। এ বিষয়ে পড়ালেখা করে সফল হতে হলে সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষ হতে হয়। ভালো কিছু করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে এবং ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। যারা সারা জীবন নতুন কিছু শিখতে চায়, প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি বা ধারণার সঙ্গে পরিচিত হতে চায় তাদের জন্য সিএসই। সিএসই পড়তে হলে সমস্যা বোঝা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা করার মানসিকতা ও সক্ষমতা থাকতে হবে। সাধারণত শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে জানে, গণিতে সাবলীল হয় তারাই কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভালো করে থাকে।

৩. সিএসই পড়লে হলে কি বাসায় কম্পিউটার থাকতেই হবে

তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে হাতে–কলমে পড়ালেখাই সিএসইতে বেশি। বাসায় কম্পিউটার থাকলে ভালো হয়। কারণ, ব্যবহারিক অনেক কিছুই শেখার সুযোগ আছে। প্রোগ্রামিং বা কোডিংয়ের মতো বিষয়গুলো শিখতে প্রচুর চর্চা করতে হয়। সে জন্য নিজস্ব কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকা ভালো। সিএসইর শিক্ষার্থীদের অনেক ইন্টার্নশিপ বা পার্টটাইম কাজের সুযোগ থাকে। এখন অনেক কাজ রিমোটলি, অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে না গিয়েই করতে হয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ যেহেতু আছে, তাই নিজের কম্পিউটার থাকা ভালো।

৪. সিএসইতে কি শুধু প্রোগ্রামং শেখানো হয়

সিএসই তে যে কেবল প্রোগ্রামিংই রয়েছে এমনটি নয়, এর পাশাপাশি রয়েছে আরো মজাদার কিছু কোর্স। কিন্তু প্রোগ্রামিংই হলো সিএসইর কোর টপিক। প্রোগ্রামিং দিয়ে মূলত সফটওয়্যার তৈরি করা হয়, অন্যান্য কোর্সগুলোতে থাকে অ্যালগরিদম, ডাটা স্ট্রাকচার ইত্যাদির মতো কিছু টপিক এবং হার্ডওয়্যার রিলেটেড বিভিন্ন ধারণা।

৫. সিএসইতে কোন কোর্সগুলো পড়ানো হয়

আগেই বলেছি, সিএসই তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কোর্সের সমন্বয়ে একটি প্রোগ্রাম। সাধারণত সিএসইতে নিম্নোক্ত কোর্সগুলো পড়ানো হয়-

-ইন্ট্রোডাকশন টু প্রোগ্রামিং

-স্ট্রাকচার্ড প্রোগ্রামিং

-অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং

-ডিসক্রিট ম্যাথমেটিক্স

-ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাফিক্স

-ইলেকট্রনিক ডিভাইসেস এন্ড সার্কিট

– মেট্রিক্সেস, ভিক্টর এন্ড জিওমেট্রি

-ইন্টেগরাল ক্যালকুলাস

-ইঞ্জিনিয়ারিং এথিক্স

-অলগরিদম ডিজাইন এন্ড এনালাইসিস

-কমপ্লেক্স ভ্যারিযেবলস, ল্যাপলেস ট্রান্সফরম এন্ড ফোরিয়ার সিরিজ

-নিউমেরিক্যাল এনালাইসিস

-থিউরি অব কম্পিউটেশন

-অপারেটিং সিস্টেম এন্ড সিস্টেম প্রোগ্রামিং

-সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ডিজাইন প্যাটার্নস

-মাইক্রোপ্রসেসর এন্ড এমবেডেড সিস্টেমস

-কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং

-মেশিন লার্নিং

-আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স এন্ড এক্সপার্ট সিস্টেম

মনে রাখা দরকার, প্রোগ্রামিং হচ্ছে সিএসইর কোর টপিক, তবে কোন প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কোন প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শেখাবে সেটা তাদের উপর নির্ভর করে। সাধারণত আমাদের দেশে C, C++, C#, Java বা Python এর মতো প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজগুলোই শেখানো হয়। তবে কোনো শিক্ষার্থী চাইলেই নিজ উদ্যোগে যেকোনো ল্যাংগুয়েজ শিখতে এবং পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে!

৬. আগে থেকে প্রোগ্রামিং জানা থাকলে সুবিধা

স্কুল বা কলেজ জীবনে প্রোগ্রামিং জানা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের কোর্সগুলোতে বেশ সুবিধা হয়। একদিকে যেমন নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন, তেমনি পুরোনো বিষয়গুলো ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। প্রোগ্রামিং বা কোডিং চর্চার বিষয়, সমস্যা সমাধানের কৌশল আয়ত্তের বিষয়। এখানে যে কেউ চর্চার মাধ্যমে কাজে দক্ষ হন এবং অনেক কিছু শেখার সুযোগ পান। তবে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের আগে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে জানার সুযোগ পাননি, তাঁদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের কোর্সগুলো এমনভাবে সাজানো হয়, যার মাধ্যমে আপনি প্রোগ্রামিং শিখতে পারবেন।

৭. সিএসই পড়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ আছে

সিএসইর শিক্ষার্থীদের জন্য শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই চাকরির নানা ধরনের সুযোগ আছে। তা ছাড়া দক্ষতার ওপর নির্ভর করে অন্যান্য খাতেও কাজ করা সম্ভব। সিএসই পড়ে আপনি যেমন প্রোগ্রামার হতে পারেন, তেমনি এমবিএ করে যেকোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন কাজ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা দায়িত্বে কাজের সুযোগ নিতে পারেন। আমাদের দেশ থেকে অনেকেই গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, ইনটেল, ডেল ও অ্যাপলের মত বিশ্বের সব জায়ান্ট কোম্পানিতে চাকরি পাচ্ছে।

শুধু কম্পিউটার সায়েন্সসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করতে হয়, বিষয়টি এমন নয়। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি এখন প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এখন অনেক সিএসই গ্র্যাজুয়েট আছেন, যাঁরা ব্যাংকে কাজ করছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করছেন, টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার দিকেও সিএসই স্নাতকদের ঝোঁক চোখে পড়ে।

সিএসই পড়ে জনপ্রিয় যেসব ভূমিকায় চাকরি করা সম্ভব, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সফটওয়্যার প্রকৌশলী, ওয়েব ডিজাইনার ও ডেভেলপার, ডেটাবেজে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার, ডেভঅপস ইঞ্জিনিয়ার, এসকিউএ ইঞ্জিনিয়ার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, আইটি কনসালট্যান্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট, ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনার ইত্যাদি। এ ছাড়া নতুন নতুন অনেক চাকরির সুযোগ প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে।

৮. সিএসই গ্রাজুয়েটদের চাকরির ক্ষেত্রে স্যালারি রেঞ্জ কেমন হয়

ফ্রেশার হিসেবে কোনো কোম্পানিতে যোগদানের পর সাধারণত ২৫ থেকে ৪০ হাজার স্যালারির চাকরি পাওয়া যায়, এমনকি ৬০-৮০ হাজারও হতে পারে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে। আর গুগলের মতো কোনো জায়ান্ট কোম্পানিতে কাজের সুযোগ পেলে স্যালারি হয়ে থাকে অনেক বেশি, এমনকি ১০-১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত।

৯. দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেমন

বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই–সংক্রান্ত গবেষণায় বেশ ভালো অঙ্কের তহবিল বরাদ্দ থাকে। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সিএসই–সংশ্লিষ্ট কোর্স পড়ার হারও অনেক বেশি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো সিএসই স্টুডেন্টদের জন্য প্রচুর স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলোতে প্রচুর পরিমাণে স্কলারশিপ পাওয়া যায় উচ্চশিক্ষার জন্য।

১০. বাংলাদেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, খরচ কেমন

বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, ঢুয়েট, ঢাবি, রাবি, চবি, জাবি শাবিপ্রবি, নর্থ সাউথ, গ্রিন, ব্রাক, ড্যাফোডিলসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিষয়টি পড়ানো হয়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রোফেশনাল কোর্সে বেশ কিছু কলেজে এই বিষয়টি পড়ানো হয়।

বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার খরচ খুবই কম। সাধারণত কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চার বছর মেয়াদি প্রোগ্রামের খরচ বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা হয়ে থাকে।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা ব্যয়বহুল। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি একেক রকম। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চার বছর মেয়াদি প্রোগ্রামের খরচ ৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অন্যদিকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইন সিএসই পড়তে খরচ হবে আট লাখ টাকার বেশি। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সিএসই পড়তে খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে খরচ ৯ লাখ টাকার বেশি। তবে এসএসসি ও এইচএসসির ফলের ওপর নির্ভর করে নানা ধরনের বৃত্তির সুযোগ আছে।

বর্তমান বিশ্ব এগিয়ে চলছে প্রযুক্তিকে পুঁজি করে। আগামীদিনে প্রযুক্তির উপর এই নির্ভরশীলতা বাড়বে কয়েকগুন। এমন প্রেক্ষাপটে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে একটি যুগোপযোগী ও বহুল সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *